হায় চিন! একদা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিনের কাঁধে আজ বেকার সমস্যার ভারী বোঝা। পুঁজিবাদী পথে হেঁটে চিনের সরকার আজ নাগরিকদের এমন উজ্জ্বল দিনই উপহার দিয়েছে!
প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে কোভিড অতিমারির পর থেকে বেকার সমস্যা ব্যাপক ভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে চিনে। গত বছর এপ্রিলের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সেখানকার ১৬-২৪ বছর বয়সী প্রায় ১০ কোটি কর্মপ্রার্থীর ২০ শতাংশেরও বেশি ছিলেন বেকার। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যতই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা বলুন না কেন, বছর পার করে ২০২৪-এর জুলাইয়েও দেখা যাচ্ছে চিনে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৭.১ শতাংশে। উচ্চশিক্ষা শেষ করলেই মোটা বেতনের চাকরির সুযোগ এবং তার দৌলতে নিশ্চিন্ত দিন কাটানোর স্বপ্ন ক্রমেই অধরা হয়ে উঠছে চিনের যুবসমাজের কাছে। কেউ সংসার চালানোর বাধ্যতায় ঢুকে পড়ছেন কম বেতনের যা পাওয়া যায় তেমন কাজেই। কেউ চাকরি খোঁজা ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পেনশনে ভরসা করে দিন কাটাচ্ছেন। আবার অনেকে চরম হতাশাগ্রস্ত ও নিরুপায় হয়ে অপরাধজগতের ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্মকেই আশ্রয় করছেন। চাকরি নিয়ে চলছে নানা দুর্নীতিও, যা চিনের সামাজিক পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তুলছে।
হুবেই ইউনিভার্সিটি অফ চাইনিজ মেডিসিনের স্নাতক আমাডা চেনের স্বপ্ন ছিল তিনি গবেষক হবেন, কিংবা কোয়ালিটি ইন্সপেক্টরের কাজ করবেন। সুযোগ মেলেনি। শেষে তাঁকে ঢুকতে হয় সেলসের কাজে। সেখানে সারা দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হত। বিনিময়ে মিলত সামান্য টাকা। বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে না পারলেই শুনতে হত বসের গালিগালাজ। শেষ পর্যন্ত কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
রাজধানী বেজিংয়ের প্রখ্যাত ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র জেফাইর কাও-এরও প্রায় একই অবস্থা। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটি হাতে নিয়ে বছরের পর বছর পুরো সময়ের কাজ খুঁজে গেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২৭ বছর বয়সে পৌঁছে বুঝতে পেরেছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী যে কাজ তাঁর পাওয়ার কথা, তা জোটার আশা নেই। তাই গ্রামে ফিরে আপাতত বাবা-মায়ের পেনশনেই ভরসা রেখেছেন কাও।
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে হাতিয়ার করে মহান মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়ার পর হাজার হাজার বছরের অন্ধকারে তলিয়ে থাকা চিনে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠেছিল উন্নয়নের আলো। দেশের সমস্ত মানুষের জন্য শুধু খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান নয়, সকলের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক চিনে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক উন্নত মানের জীবনযাত্রার অধিকারী হয়েছিলেন। ঘুচে গিয়েছিল মানুষে মানুষে আর্থিক বৈষম্য। অতীতের অনাহার আর শোষণ-বঞ্চনার কালো দিন পেরিয়ে এসে মাথা উঁচু করে বাঁচার মর্যাদাময় জীবনের সন্ধান পেয়েছিলেন চিনের মানুষ।
১৯৭৬-এ মৃত্যু হয় চিন বিপ্লবের রূপকার মহান মাওয়ের। এর পর ক্ষমতা দখল করেন সংশোধনবাদী নেতা দেং শিয়াওপিং। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রের প্রধান হন তিনি। ক্ষমতায় বসে সমাজতন্ত্র ধ্বংসের মতলবে ‘মাও সে তুং জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দিতেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নানা কৌশলে তিনি পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকেন। যে কোনও উপায়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে– এই ধুয়া তুলে ১৯৭৮-এ চিনের অর্থনীতিতে তিনি সংস্কার ও মুক্ত-দুয়ার নীতি চালু করেন। নাম দেওয়া হয় ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’। তাঁর বিখ্যাত লক্ষ্যছিল– ‘বেড়াল যতক্ষণ ইঁদুর ধরতে পারছে, ততক্ষণ তার রঙ সাদা না কালো, তা দেখার দরকার নেই’। অর্থাৎ পুঁজি ব্যবহার করে উৎপাদন করতে পারলেই হল, সেই পুঁজি সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, নাকি জনগণকে শোষণ-লুণ্ঠনের পথে পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে– তা বিচার করা নিষ্প্রোজন। চিনের শাসক দলও মানুষকে ধোঁকা দিতে কমিউনিস্ট পার্টি নামটি বজায় রেখেই পুরোপুরি একটি বুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হয়ে যায়।
সরকারের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশি পুঁজি মুনাফা লুটতে ঢুকতে থাকে চিনের মাটিতে। ক্রমাগত বাড়তে থাকে বেসরকারি পুঁজিপতির সংখ্যাও। চিনের সস্তা শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত মুনাফা বাড়াতে থাকে তারা। পরিণামে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার গতি পায় এবং জাতীয় আয়ও বাড়ে। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়তে থাকে চিনা শ্রমিক-কর্মচারীদের শোষণ-বঞ্চনার মাত্রা। কারণ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটির ভিত্তিই হল শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মালিকের মুনাফা-লুটের বন্দোবস্ত করা। চিনে একের পর এক গজিয়ে উঠতে থাকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড, যেখানে মালিকের মুনাফার স্বার্থে শ্রম-আইন বা শ্রম-অধিকারগুলির কোনও অস্তিত্বই থাকে না। পরিণামে, যে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দূর করে দিয়েছিল মাও সে তুংয়ের চিন, পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথে হেঁটে দেং শিয়াওপিং-এর চিনে আবার উঁকি দিতে থাকে তার বীভৎস চেহারা।
পুঁজিবাদী চিন আজ এক বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আধিপত্যের সম্প্রসারণ ঘটাতে সামরিক শক্তি বাড়ানো, বাণিজ্যিক নানা কৌশল গ্রহণ ইত্যাদি কোনও কিছুকেই আজ চিনের সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা বাদ দেন না। চিনের একচেটিয়া পুঁজিপতিরা আজ বিপুল সম্পদের অধিকারী। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিজস্ব নিয়মেই সেখানে মানুষে মানুষে আজ বিপুল বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। রমরমা হয়েছে দুর্নীতিরও। সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতর হতে থেকেছে বেকার সমস্যা। জাতীয় আয়ের দিক থেকে চিন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। অথচ আজ এই বিপুল সম্পদশালী দেশটির বাতাস প্রতি মুহূর্তে ভারী হয়ে উঠছে বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত লক্ষ লক্ষ কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীর দীর্ঘশ্বাসে। বাস্তবে পুঁজিবাদী উন্নয়নের আর্থিক সাফল্য কুড়োচ্ছে চিনের মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি, আর তার ক্লেদ-কুফলগুলি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম।
ভারতও নাকি অচিরেই পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হতে চলেছে। অন্তত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো তেমনই দাবি করেন। অথচ দেশে বেকার সমস্যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কর্মহীনতার চেহারা এতটাই বীভৎস যে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশই বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। কর্মহীন তারুণ্যের আর্তনাদ যাঁদের কষ্ট দেয়, যাঁরা সত্যিই বেকারত্বমুক্ত দেশ চান, যাঁরা জাতীয় আয়ের অঙ্কটির বিশালতা দিয়েই শুধু দেশের উন্নয়ন মাপেন না, তাঁরা মাও সে তুংয়ের সমাজতান্ত্রিক চিন থেকে আজকের পুঁজিবাদী চিনের ক্রম-অধোগমন খতিয়ে দেখলে বেকার সমস্যা সমাধানের সত্যিকারের পথটির খোঁজ অবশ্যই পাবেন।