ট্রাস্টের নাম ‘পিএম কেয়ার্স’। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অমিত শাহ সহ তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রয়েছেন ট্রাস্টি বোর্ডে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার তহবিল থেকে তাতে টাকা ঢালা হয়েছে। সরকারি কর্মীদের বেতন থেকেও কার্যত গায়ের জোরে টাকা কেটে দেওয়া হয়েছে এই তহবিলে। শত শত কোটি টাকা ঢেলেছে দেশের বেসরকারি সংস্থাগুলিও। তহবিলের নাম এবং তা ভরাতে সরকারি তৎপরতা যতই থাকুক না কেন, এটি নিয়েই তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা– আদৌ কি এটি সরকারি তহবিল?
প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত এই তহবিল নথিভুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগে। অথচ এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি কোনও সরকারি ট্রাস্ট নয়। কেন্দ্র কিংবা কোনও রাজ্য সরকার এই তহবিল বা দানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে না। এদিকে আবার সরকার বাহাদুর ২০২০-র ডিসেম্বরে জানায় এটি সরকারি তহবিল, কিন্তু তা তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় নয়। অর্থাৎ দেশের নাগরিকরা এই তহবিল সম্বন্ধে কোনও তথ্য পাওয়ার অধিকারী নন। পিএম কেয়ার্সের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই সরকারি হিসাব পরীক্ষক সংস্থা সিএজি-র। জাতীয় ত্রাণ তহবিল থাকা সত্ত্বেও করোনা অতিমারি মোকাবিলার নামে প্রধানমন্ত্রী লকডাউনের মধ্যে ২৭ মার্চ’২০ যখন পিএম কেয়ার্স ফান্ড তৈরি করেন, তখনই এর পিছনের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল।
সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুসারেই যেটি সরকারি ট্রাস্ট নয়, সেটি নথিভুক্ত হওয়ার পরের দিনই কেন্দ্রীয় কর্পোরেট মন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে যে খরচ করার কথা, সেই ‘কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি’র (সিএসআর) টাকা পিএম কেয়ার্সে দিতে পারবে। যদিও কোম্পানি আইনে পরিষ্কার লেখা আছে, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল, ত্রাণ তহবিল, তফশিলি জাতি, জনজাতির উন্নয়ন তহবিলেই কেবলমাত্র সিএসআর-এর টাকা গ্রহণ করা যায়। পিএম কেয়ার্স তৈরি করে সরকার বলেছিল করোনা মহামারি জনিত যে কোনও ধরনের জরুরি পরিস্থিতি সামলাতে, দুর্গতদের সাহায্য দানে এই তহবিল ব্যবহৃত হবে। পিএম কেয়ার্স তহবিলের গঠন নিয়েই শুধু ধোঁয়াশা রয়েছে তা নয়, একই রকম অস্বচ্ছতা তার খরচের বিষয়েও। কোথায় কোন বিষয়ে এই ফান্ড থেকে খরচ করা হল, করোনা জনিত কারণে ক্ষতির সম্মুখীন কোন ব্যক্তি সাহায্য পেলেন, দেশের কোটি কোটি কাজ হারানো শ্রমিকরা, করোনায় স্বজন হারানো একটিও দরিদ্র পরিবার সাহায্য পেয়েছেন কিনা কিছু জানার সুযোগ রাখেনি কেন্দ্রীয় সরকার। তা হলে কেন এত গোপনীয়তা? সরকারের নামে চলা এই তহবিলের স্বচ্ছতা থাকবে না কেন? তবে কি সরকারের নামে ফান্ড খুলে বিপুল পরিমাণে টাকা তুলে অন্য কোনও উদ্দেশ্যে খরচ করা হবে?
কী পরিমাণ টাকা জমা পড়েছে এই তহবিলে? ফান্ড তৈরি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে জমা পড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ৩১মে পর্যন্ত জমা পড়া টাকার পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি ফান্ডে জমা দিয়েছে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ৫০০ কোটি, টাটা গোষ্ঠী ৫০০ কোটি, আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠী ৪০০ কোটি, আদানি গোষ্ঠী ১০০ কোটি। এ ছাড়া মাহিন্দ্রা গোষ্ঠী, টেক মাহিন্দ্রার মতো বেসরকারি সংস্থার তরফেও বিপুল অনুদান জমা পড়েছে এই তহবিলে। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক সর্বোচ্চ ৮০কোটি, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক ৭০ কোটি টাকা দিয়েছে। ইয়েস ব্যাঙ্ক এই তহবিলে ঢেলেছে ১০কোটি টাকা এবং কর্মীদের একদিনের বেতন থেকে কেটে ১.৯ কোটি টাকা দিয়েছে। বেসরকারি অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কও কর্মীদের মাইনে থেকে কেটে টাকা দিয়েছে, আরও ১০০ কোটি টাকা তারা এই কাজের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির তহবিল থেকে মোট ২১০৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এই ফান্ডে। কিছু বিদেশি অনুদানও এই ফান্ডে এসেছে বলে শোনা গেছে। প্রসঙ্গত, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক, ইয়েস ব্যাঙ্ক এই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির পরিচালন কর্তারা নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। কর্তাদের দুর্নীতিতে দেউলিয়া হতে বসা ইয়েস ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে সম্প্রতি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে প্রচুর টাকা ঢালতে হয়েছে। আম্বানি, আদানি গোষ্ঠী লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিপুল সম্পদ কার্যত লুঠ করেছে তাও দেশের মানুষের অজানা নয়। এই সমস্ত ধনকুবেরের দল এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কের লুঠেরা পুঁজিপতিরা সরকারের নামে চলা কার্যত বিজেপি নেতাদের ফান্ডে ‘কেয়ার’ দানের জন্য কেন এত উঠেপড়ে লেগেছে তা বুঝতে কোনও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। জনগণের সর্বস্ব লুঠের কারবারে সরকারকে পাশে পেতে, জলের দরে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি হাতাতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা ঋণ আত্মসাৎ করেও বুক ফুলিয়ে আবার ঋণ চাইতে, ট্যাক্স ছাড়ে স্বর্গরাজ্যের সুবিধা পেতে, বিনিয়োগের নামে সব নিয়ম কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর কাজে সরকারের বদান্যতা পেতেই কি পিএম কেয়ারে টাকা ঢালার ব্যবস্থা?
সব কিছু দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক ‘পিএম কেয়ার’ মানে হল বিজেপি কেয়ার। এমনিতেই দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের সবচেয়ে বড় পছন্দের তালিকায় এখন আছে বিজেপি। এই ধনকুবের কর্পোরেট মালিকদের বদান্যতায় বিজেপির ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, ২৯০৪ কোটি টাকা (২০১৮-১৯ সালে)। এছাড়াও কালো টাকার আশীর্বাদ তো বিজেপির দিকে আছেই। টাকার পাহাড়ে বসে থাকা বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে প্রায় রিক্সা ট্যাক্সির মতো করে হেলিকপ্টার আর চার্টার্ড প্লেন ব্যবহার করে চলেছেন। তাঁরা ক্যামেরার সামনে গরিবের দাওয়ায় বসে ভাত খাচ্ছেন, কিন্তু আসলে তাঁরা মহার্ঘ পাঁচতারা হোটেলের বাসিন্দা। পিএম কেয়ারের তহবিলের অস্বচ্ছতার সুযোগে এই খরচের একটা অংশ ঘুরপথে ওই ফান্ড থেকে আসছে কি না, তা বিজেপি নেতারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে সাদা টাকায় যে এই বিপুল খরচ সম্ভব নয়, সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিতে পিএইচডি হওয়ার দরকার হয় না। ভোটের বাজারের দেশ সেবকরা আসলে পুঁজিপতিদের সেবক। ‘পিএম কেয়ার্স’ আসলে পুঁজিপতিদের কেয়ারে বিজেপি নেতৃত্বের উদ্ভাবন বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।