পানচাষিদের দীর্ঘ আন্দোলনের জয়

৭ ফেব্রুয়ারি কাকদ্বীপ এসডিও অফিসে ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে পানচাষিদের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দাবি আদায় হল। চাষের উপকরণ সার, কীটনাশক, বিভিন্ন রাসায়নিক ওষুধের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির প্রাইভেট বাজারগুলিতে পাইকারি ক্রেতা ও কমিশনভোগী আড়তদারদের মিলিত অসাধুচক্রের ফাঁদে পড়ে চাষিদের অবস্থা সঙ্গিন। চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে ৫০টি পান পাতায় গুছির বদলে বাংলা পানে ১৫০-২০০ এবং মিঠাপানে ২৫০-৪০০ পর্যন্ত পানপাতা দিতে চাষিদের বাধ্য করা হচ্ছিল। অন্য দিকে নিলামে ওঠা দরের ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ বাদ দিয়ে চাষিকে দেওয়া হচ্ছিল। চাষির তৈরি পানের বান্ডিল (মোট) থেকে ১-২ গুছি কমিয়ে দেওয়াটাই যেন বাজারগুলির নিয়ম। মোট পিছু ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাজার কর্মচারীদের নজরানা না দিলে দাম কম দেওয়ার হুমকি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পানের পাইকারি বাজারে ৯ শতাংশ কমিশন চালু আছে। অন্য ফসলে যা ৫ শতাংশ।

এর বিরুদ্ধে পানচাষিরা ক্ষুব্ধ। ২০১৭-র নভেম্বরে পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়ি পান বাজারে চাষিদের বিক্ষোভের ঢেউ এসে পৌঁছয় কাকদ্বীপ মহকুমার পানবাজারগুলিতে। সারা বাংলা পানচাষি সমিতির নেতা চিত্তরঞ্জন জানা, কার্তিক দাস, নির্মল জানা, নারায়ণ দাস বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের ঐক্যবদ্ধ করে সঠিক পথে আন্দোলন গড়ে তুলতে স্থানীয় চাষি কমিটি গড়েতোলার উদ্যোগ নেন।

২০১৮-র ১৪ ফেব্রুয়ারি এক কনভেনশনের মাধ্যমে পান চাষিদের সংগঠন–কাকদ্বীপ মহকুমা পান চাষি সমিতি তৈরি হয়। পরে পরিবর্তিত হয় সারা বাংলা পানচাষি সমিতিতে। যদিও কিছু সুবিধাবাদী নেতা হঠকারী পদক্ষেপ নেওয়ায় চাষিদের বিভ্রান্তির সুযোগে ব্যাবসায়ী আড়তদাররা পোষা গুন্ডা দিয়ে আন্দোলনের নেতাদের আক্রমণ করে, তেমনই পাশাপাশি দালাল সংগঠন গড়ে তোলে। আড়তদাররা সংগঠনের নেতাদের পুলিশ কেসে জড়িয়ে দেয়।

তবুও কুলপি ও কাকদ্বীপ ব্লকে গড়ে ওঠে পানচাষি সুরক্ষা সমিতি। এ ক্ষেত্রে ছাইপউদ্দিন পাইক, ফকিরচাঁদ মোল্লা, চূড়ামণি মণ্ডল প্রমুখ নেতাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা এই সফল আন্দোলনে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই সমিতি পরবর্তীকালে সারা বাংলা পানচাষি সমিতির সাথে যুক্ত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি কাকদ্বীপ মহকুমা শাসকে জানায়, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে ওই দিন এসডিও অফিসে হাজার হাজার চাষি ধর্নায় বসবেন। প্রশাসন বাধ্য হয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি সমাধান সভার আহ্বান করে।

সারাবাংলা পানচাষি সমিতি নভেম্বর মাস থেকে এসডিও, ডিএম, কৃষিবিপণন দপ্তর, হর্টিকালচার দপ্তর এবং মন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত দাবি পত্র দিয়েছে। তারা এলাকায় এলাকায় সভা করে সংগঠন ও শক্তিশালী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আড়তদাররা দালালদের নামিয়ে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এসডিও-র সাথে বৈঠকেও তারা দালালদের ঢোকায়।কিন্তু সারা বাংলা পানচাষি সমিতির নেতা ও চাষিদের অনমনীয় দৃঢ়তার কাছে সব অপকৌশল বানচাল হয়ে যায়।

অবশেষে প্রশাসন ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ৫০ পান পাতায় গুছি ধরতে হবে, নিলামের ঘোষিত মূল্যের সবটাই দিতে হবে চাষিকে, আড়ত কমিশন ৯ শতাংশ বাতিল করে গ্রহণযোগ্য পরিমাণ ধার্য করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত আগামী ১ বৈশাখ থেকে কার্যকর হবে বলে ঠিক হয়। আন্দোলনের এই জয়ে দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অন্যতম শরিক সংগঠন এআইকেকেএমএস-এর কাকদ্বীপ সাংগঠনিক জেলা সম্পাদক নারায়ণ হালদার আন্দোলনকারী চাষি ও নেতৃত্বকারী সংগঠনকে অভিনন্দন জানান।