ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক বিরোধীর দাপাদাপি, মিটিং মিছিলে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা, নেতা-নেত্রীদের একে অপরকে দেখে নেওয়ার হুমকি। পরিণতি– শাসক এবং বিরোধী পক্ষের কর্মী-সমর্থকের একের পর এক মৃত্যু। যাঁরা মারা গেলেন তারা সবাই দিন আনা-দিন খাওয়া পরিবারের মানুষজন। এইসব মর্মান্তিক মৃত্যু কিছু বার্তা দিয়ে গেল কি?
দেশের প্রতিটা নির্বাচনেই চাষি, মজুর, খেটে-খাওয়া পরিবারের মানুষজন মারা যান। হাসপাতালের মর্গে, রাস্তার আনাচে কানাচে যে মৃতদেহগুলো নিস্তব্ধ পড়ে থাকে, যাদের পরিবারের কান্নার ছবি খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় ভিড় করে তারা কেউই আদানি, আম্বানি, বিড়লা, টাটার পরিবারের আত্মীয় পরিজন নয়। কোনও এক অদৃশ্য কারণে গণতন্তে্রর নিশান বহনের সব দায় শুধু তাঁদের, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জমিতে ফসল ফলে, কারখানায় পণ্য উৎপাদিত হয়।
ভোট এলেই বাতাসে ভাসে বারুদের গন্ধ। নির্বাচনী প্রচারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বোমা, গুলি, বন্দুকের আওয়াজ। লাফিয়ে বাড়ে লাশের সংখ্যা। কীসের জন্য এই হানাহানি? মারামারি? শাসক শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের জন্য? বিপ্লবের জন্য? নিশ্চিত উত্তর ‘না’। এ লড়াই আসলে পুঁজিপতি শাসকের রাজনৈতিক ম্যানেজার নির্বাচনের লড়াই। সাধারণ মানুষ এখানে শুধুই দাবার বোড়ে। এরা লড়ে, এরা মরে।
গণতন্ত্রের পাহারাদাররা নির্বাচন নিয়ে যতই বড়াই করুক, যতই তারা বলুক যে নির্বাচনী ব্যবস্থা এমন এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জনগণ তাঁদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করে থাকেন, গণতন্তে্র গণদেবতাই শেষ কথা– বাস্তব কি তাই? আসলে নির্বাচন একটা প্রহসন। সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর একটা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, যার মাধ্যমে পুঁজিপতি শাসক শ্রেণি বছরের পর বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বহাল থাকে তার রাজনৈতিক ম্যানেজারের পরিবর্তনের কার্যক্রম। যখনই কোনও স্তরে ক্ষমতায় থাকা কোনও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়, শাসক শ্রেণি তার অনুগত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জনমত তৈরি করে ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলটিকে সরিয়ে অন্য দলকে ক্ষমতায় আনে। ভাবখানা এমন যেন ওই দলকে সরিয়ে অন্য দলকে আনলে সব সমস্যার সমাধান হবে। আমরাও নিজেদের অজান্তেই এই ফাঁদে পা দিয়ে থাকি। এ যুগের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটা সরকারের বিরুদ্ধে যখন জনগণ বীতশ্রদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে তখন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আর একটা সরকার আসে। সাধারণ মানুষ কতগুলি লোককে অসৎ মনে করে। ভাবে, সেই লোকগুলিকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় অন্য কতগুলি সৎ লোক এসে বসলেই তাদের মঙ্গল হবে। এ ধরনের প্রচার বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা করে থাকে। কাজেই আমি শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বলছি, তাঁরা যেন এই ধরনের ভাঁওতায় না ভোলেন। …ভোটের মারফত হাজার বার সরকার পাল্টে বা আক্ষরিক অর্থে আইনকানুন সংশোধন করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে জনসাধারণের পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। এই মুক্তি অর্জনের একমাত্র পথ হচ্ছে, জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সঠিক বিপ্লবী কায়দায় পরিচালনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে জনসাধারণের অমোঘ সংঘশক্তি গড়ে তোলা এবং বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির দলের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা।’
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে এবং রাজ্যে বহু বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতার মসনদে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ জামা পরা নতুন নতুন রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের জোটের আবির্ভাব হয়েছে। সাধারণ মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটেনি, তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। বেকারত্ব দূর হয়নি, ক্ষুধা-মন্দাও দূর হয়নি। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় কারখানা বন্ধ, লে-অফ, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের খবর। ফসলের উপযুক্ত দাম না পেয়ে, ঋণ শোধ করতে না পেরে কৃষকের আত্মহত্যার খবর। সামাজিক অবক্ষয় বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আশি বছরের বৃদ্ধা কিংবা আট বছরের নাবালিকাও ধর্ষণের শিকার। ড্রাগের নেশায় আসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মার খুন হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাও খবরের কাগজের পাতায়, টিভির পর্দায় হামেশাই দেখা যায়। নারী পাচার, শিশু পাচার আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এইসব দেখতে দেখতে আমাদের কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। অন্য দিকে আমাদের দেশের শিল্পপতিদের সম্পদ বৃদ্ধিচোখে পড়ার মতো। বিশ্বের তাবড় শিল্পপতিদের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের দেশের শিল্পপতিদের ধনসম্পদ। ফোর্বসের ২০২৩ সালের বিলিয়নেয়ারদের তালিকা অনুযায়ী শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি ভারতের তথা এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি বিশ্বের প্রথম দশজন ধনীর তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছেন। ফোর্বস ২০২৩ সালের ধনী ব্যক্তির তালিকায় শিল্পপতি গৌতম আদানি, শিব নাদাল, সাইরাস পুনাওয়ালা, লক্ষ্মী মিত্তল, সাবিত্রী জিন্দাল, দিলীপ সাংঘভি, রাধাকৃষ্ণ দামানির নাম উঠে এসেছে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল ভারতের আর্থিক বৈষম্য সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মাত্র ১ শতাংশ সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির হাতে রয়েছে ভারতের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ। বিপরীতে আর্থিক সক্ষমতার দিক থেকে জনসংখ্যার নিচের দিকের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশের সরকারের সংগৃহীত মোট জিএসটির ৬৪ শতাংশ আসে এই দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ জনগণের থেকে। দেশের ধনীতম ১০ শতাংশ থেকে সংগৃহীত জিএসটির পরিমাণ সংগৃহীত মোট জিএসটির মাত্র ৪ শতাংশ।
নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোট আসে, সাধারণ মানুষ সেই ভোট প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করে, কখনও সখনও শাসন ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন হয়, আর সাথে অতিরিক্ত প্রাপ্তি বলতে শুধু মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, মৃত্যু, রক্তপাত, গরিবের আরও গরিব হওয়া কিংবা ধনীর আরও ধনী হওয়ার গল্প, আর আমাদের আশেপাশে থাকা অল্প কিছু কেষ্ট- বিষ্টুর একতলা থেকে তিনতলা বাড়ি, ভাঙা সাইকেল থেকে দামী গাড়ি। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরে।
জিশু সামন্ত, খানাকুল, হুগলি