Breaking News

পাঠকের মতামতঃ মৃত্যু-উল্লাস!

প্রিয় টিমের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দ অনুষ্ঠানে এসেছিল অগণিত মানুষ। এসেছিল বললে ঠিক বলা হবে না, তাদের টেনে আনা হয়েছিল। একটি টিমের আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবর এমন ভারে প্রচার করা হয়েছিল যেন ভারত প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপ জিতে ফিরেছে! মানুষও প্রচারের এই জোয়ারে গা ভাসিয়ে পেতে রাখা মৃত্যুফাঁদে পা দিয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানস্থল যে এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, কেউই কল্পনা করতে পারেনি।

ভারতে ক্রিকেট খেলাকে নিয়ে কী ভাবে সারা বছর প্রচার হয়, কী ভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে ক্রিকেটারদের ভগবান বানিয়ে দেওয়া হয় এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতারা খেলাধূলার সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে কেমন করে চালিয়ে দিতে চায়, তা আগেও নানা সময় লক্ষ করা গেছে। আনন্দের বিষয়, আঠারো বছর পর রয়েল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি) আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে আইপিএল-এর মতো একটি ক্রিকেট লিগ নিয়ে এমন প্রচার হয়, যা শুরু হলে মনে হয় যেন দেশে অলিম্পিক শুরু হয়েছে! মোড়ে মোড়ে টিভির সামনে ভিড়। সবাই মোবাইল হাতে খেলা দেখায় ব্যস্ত। আবার একদল এই নিয়ে জুয়া খেলতে ব্যস্ত। খেলার মাধুর্য, সৌন্দর্যের থেকেও প্রধান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মুনাফা। বর্তমানে দেশের কোটি কোটি মানুষের হাজার সমস্যা, যেগুলি বৃহৎ সংবাদপত্র, টিভি ছুঁয়েও দেখে না, তারাই কিন্তু আরসিবি-র জয়ের খবর নিয়ে উন্মাদনা তুলেছে। চারিদিকে ব্যাপক প্রচারে মনে হবে ভারত খেলাধূলায় ইতিমধ্যেই বিশ্বগুরু হয়ে গেছে!

আইপিএল চ্যাম্পিয়নদের বরণ করতে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আয়োজন। যে স্টেডিয়ামে প্রায় ৩৩ হাজার দর্শক ধরে, সেখানে প্রায় দু-তিন লাখ দর্শক এসে হাজির। অথচ ভিড় নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও ব্যবস্থা নেই। একদিকে যখন ভিড়ে মানুষ স্টেডিয়ামের বাইরে পদপিষ্ট হয়ে মর্মান্তিক ভাবে মারা যাচ্ছে, ঠিক তখনই ভিতরে অনুষ্ঠান চলছে! যে সমর্থকদের সমর্থন ছাড়া একটা দল সফল হতে পারে না, তাদের সম্পর্কে কোনও অনুভূতি উপস্থিত কারও মধ্যে দেখা গেল না! এমনকি যে ক্রিকেটারদের সমর্থকরা ভগবান বানিয়েছে তাদের মধ্যেও নয়! বাইরে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জন তরতাজা মানুষের প্রাণ গেল, ৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হল।

বড় বড় শিল্পপতিরা মানুষকে ক্রেতা হিসেবে দেখে, আর ভোটবাজ দলগুলো মানুষকে দেখে ভোটার হিসাবে। এর বাইরে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য এদের কাছে কিছুমাত্র নেই। এতজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভোটবাজ নেতারা একে অপরের দিকে কাদা-ছোঁড়াছুড়ি করছে। অপর দিকে ক্রিকেটের ভগবানেরা দিব্যি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে!

কিছুদিন আগে মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে কী ভাবে মানুষ মারা গেছে তার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। দক্ষিণ ভারতে প্রায়ই সুপারস্টারদের সিনেমা রিলিজ হওয়ার সময় তীব্র উন্মাদনায় ভক্তরা পদপিষ্ট হন। কোনও ক্রিকেটার, কোনও সুপারস্টার, ভোটসর্বস্ব কোনও রাজনৈতিক নেতা, কারও এসব নিয়ে চিন্তা নেই। তারা এই সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোক, সাধারণ মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। অতীতে ছাত্রছাত্রীরা খেলাধুলো করত মাঠে ময়দানে। এখন খেলাধূলার থেকে খেলা দেখতেই ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি পছন্দ করে। না হলে মোবাইল গেমেই তারা ব্যস্ত। খেলার মধ্যে যে নৈতিকতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ছিল তা বর্তমানের মুনাফাসর্বস্ব দুনিয়ায় প্রায় নেই বললেই চলে। আজ ক্রিকেটের নামে আইপিএল করে ভারতীয় বোর্ড ব্যাপক ব্যবসা করল, প্রতিটা টিমের মালিক ব্যাপক লাভবান হল, ক্রিকেটারদের সম্পদ আরও বাড়ল, আর তার বিনিময়ে এতজন ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের প্রাণ গেল, আহত হল, পঙ্গু হল।

মনে রাখা দরকার, যুগে যুগে খেলাধূলা শোষিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। আজ সেই উন্নত সংস্কৃতির আধারে খেলাধূলার সেই গৌরব শোষিত মানুষকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।

অর্ঘ্য প্রধান

পূর্ব মেদিনীপুর

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা  ১৩ – ১৯ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত