‘রাষ্ট্রহীন অ-নাগরিক’ শীর্ষক হর্ষ মান্দারের প্রতিবেদনটি (০১/০৬) প্রণিধানযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় নিপীড়নের দিক যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনই এ দেশে এনআরসি, এনপিআর-এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি এটিকে যথার্থই হিটলারের জর্মানির ‘নুরেমবার্গ’ আইনের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন। সেখানে যেমন এই আইন বলে ভিন্ন ধর্মে বিয়েকে বেআইনি বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জার্মান-ইহুদিদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং ভিন্ন ধর্মে বিয়ে ও যৌনতা অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল, তেমনই এখানেও নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করে মুসলমান নাগরিকদের সম-নাগরিকত্বের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি ঠিকই উল্লেখ করেছেন যে, এর ফলে সে দিন জার্মানির ইহুদিরা হয়ে যান রাষ্ট্রহীন, অ-নাগরিক। ইহুদি ও জার্মানদের মধ্যে বিয়ে ও যৌনতা ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রবন্ধ লেখক এর থেকে উদ্ভূত বিপজ্জনক এবং চূড়ান্ত অমানবিক দিকটি তুলে ধরে সময়োচিত এবং খুবই জরুরি কাজটি করেছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রবন্ধটিতে যে ভাবে আলোচনা করা হয়েছে তার ফলে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ যে উদ্বাস্তু সমস্যা তার উপর যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়নি। অথচ এই সমস্যাটির ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্যক উপলব্ধি করতে না পারলে সমসাময়িক সমস্যা বা ঘটনাবলির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সার্ধ শতাব্দীব্যাপী বিশ্ব কাঁপানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, শত সহস্র শহিদের রক্তে রাঙানো দুর্জয় স্বাধীনতা সংগ্রাম– শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও হিন্দু রাষ্ট্র বা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হয়নি। বহু জাতি, উপজাতি, বহু বিচিত্র, বহু ধর্মাবলম্বী, বহু ভাষাভাষী জনগণ অধ্যুষিত এই বিশাল ভারতবর্ষে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে সকল জনগণের একটি সার্থক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। আজ চূড়ান্ত ট্র্যাজিক হলেও এটাই বাস্তব ঘটনা যে ছদ্মবেশী চক্রান্তকারী চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক শক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান লক্ষ্যের বুকে ছুরি মেরে ধর্মের ভিত্তিতেই অখণ্ড ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে দুটি রাষ্ট্র – পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান তথা ভারতের জন্ম দিল। একটি হল ঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান, অন্যটির নাম যাই হোক বাস্তবে এবং ধ্যান ধারণায় জন্মলগ্নে ভারত নামে একটি হিন্দু রাষ্ট্র। আজও সেই ধারণা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গিয়েছে তা বলা যায় না।
চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক দল সমূহ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের প্রশ্রয়ে স্বাধীনতার প্রাক্কালে অখণ্ড ভারতবর্ষে সংঘটিত হল পাশবিক নারী নির্যাতন এবং রোহমর্ষক সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণামে দ্বিখণ্ডিত হল অখণ্ড ভারত। জন্ম নিল ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান এবং ভারতে শুরু হল অসহায় নিরুপায় ভীত সন্ত্রস্ত আবাল বৃদ্ধ বনিতার ঘরবাড়ি সম্পত্তি সব ছেড়ে স্থায়ীভাবে ভারতে প্রবেশ করা। এই দেশ ছাড়ার স্রোত উভয় দেশেই মারাত্মক আকার ধারণ করল। এইভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজেদের আপন দেশে যাচ্ছেন বলে যে সব হিন্দুরা ভারতে প্রবেশ করলেন তাদেরই সেদিন বলা হয়েছে উদ্বাস্তু এবং একই ভাবে, প্রায় একই পরিস্থিতিতে ভারত থেকেও যে সব মুসলমান মানুষ নিজেদের দেশে যাচ্ছেন বলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন তাদেরও পাকিস্তানে বলা হল ‘মোহজির’ অর্থাৎ শরণার্থী। তাদের এই দেশত্যাগও সংখ্যায় ব্যাপক হয়েছে। নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তির পর তাদের একটা অংশ ভারতে ফিরে এলেও লাখ লাখ মুসলিম উদ্বাস্তুরা পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছেন। তারাও সেখানে মুসলিম শরণার্থী হিসাবে গণ্য হয়েছেন। পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব এবং ভারত অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবে কার্যত জনগণের বিনিময় হয়েছে। সেদিন এই অভূতপূর্ব মানবিক সমস্যা সমগ্র দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্বাস্তু সমস্যার মূলে নিহিত যে ভয়ঙ্কর ঘটনাবলি সেগুলি ভারতবর্ষের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকল মানুষকে সেদিন স্বাভাবিক কারণেই আবেগ বিহ্বল করে তুলেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই– সমগ্র পাকিস্তানেও মানবিক কারণে সেখানকার মোহাজির’-দের সম্পর্কে পাকিস্তানের জনগণকে একই ভাবে আবেগময় করে তুলেছিল।
এই আবেগ বিহ্বল পরিস্থিতিতেই গান্ধীজি থেকে শুরু করে দলমত নির্বিশেষে সকল দেশনেতা– নেহেরু, প্যাটেল সহ সকল ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধানরা, যে লাখো লাখো উদ্বাস্তু এ দেশে ঢুকেছেন তাঁদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান– উভয় অংশের যে হিন্দু জনসাধারণ তখনও সেখানেই রয়েছেন, তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেছেন– আপনাদের জীবন, আত্মসম্মান এবং আপনাদের জীবনের নিরাপত্তা যদি মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হয় তা হলে ভারতের দরজা আপনাদের জন্য সবসময় খোলা থাকবে। জাতির পক্ষ থেকে সেদিন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু পার্লামেন্টেও আনুষ্ঠানিক ভাবে এই আশ্বাস দিয়েছেন। এটা জাতীয় দায়বদ্ধতা হিসাবেই লিপিপদ্ধ হয়ে আছে। এটি ভুলে যাবার নয়। আজ পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু সংখ্যায় নিতান্তই কম। তাদের বেশিরভাগ আগেই দেশত্যাগ করে ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার হিন্দুদের দেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। হয়ত আগামী দিনে আরও হ্রাস পাবে। এই পটভূমিতেই অবিভক্ত ভারতের শরণার্থী সমস্যা বা উদ্বাস্তু সমস্যাকে বিশেষ রূপে ধরতে হবে ও আর পাঁচটা শরণার্থী সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে এর মধ্যে যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা রয়েছে সেই সত্যটা হারিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এই শরণার্থীদের নাগরিকত্বের অধিকার প্রশ্নাতীত। এঁরা মনেপ্রাণে ভারতীয়। ভারতের জনগণও এঁদের পরমাত্মীয়, আপনজন বলেই মনে করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক কথা হচ্ছে– কিছু কিছু রাজ্যে কিছু কিছু মানুষ এই শরণার্থী সমস্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ভুলে গিয়ে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ভাবনা-চিন্তার শিকার হয়ে এদের নাগরিকত্বের বিরোধিতা করছেন। এটা সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অনৈতিকহাসিক। এটা বিহিত করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলে এঁদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যথার্থই জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই সঙ্গে, এই কথাও উল্লেখ করা দরকার যে, এই প্রেক্ষাপটে তত্ত্ব এবং সত্যের দিক থেকে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মুসলিম শরণার্থীর ধারণাটিই যেমন একেবারে মিথ্যা, তেমনি বাস্তবেও কোনও মুসলিম শরণার্থী নেই। বিচ্ছিন্ন ভাবে অর্থনৈতিক কারণে মাইগ্রেশনের ঘটনা টুকটাক সব দেশেই আছে। তাকে শরণার্থী সমস্যা বলে গণ্য করা যায় না।
জয়দেব চক্রবর্তী, খড়গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
চিঠিটি আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯ জুলাই ’২৪ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ কর্তৃপক্ষ বাদ দেন। পুরো চিঠিটি ছাপার অনুরোধ করে লেখক আমাদের দপ্তরে পাঠান। লেখাটির গুরুত্ব অনুভব করে আমরা তা প্রকাশ করলাম।