পাঠকের মতামতঃ পুলিশি রাজ আনছে বিজেপি

ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় দণ্ড সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম– ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তে যথাক্রমে ওই তিনটি আইন চালু হবে ১ জুলাই থেকে। এগুলি ফের খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখলেন আইনজীবীদের সংগঠন দিল্লি বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি, সম্পাদক ও দুই সদস্য। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কেও। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী আইনজীবীদের মতে, এই তিন আইনে পুলিশরাজ চালু হতে পারে দেশে। বিজেপি সরকার সংসদে কোনও আলোচনার সুযোগ না দিয়ে এগুলি পাশ করিয়েছে।

দিল্লি বার কাউন্সিলের সদস্যদের তরফে জানানো হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশি ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। স্বচ্ছ ও উপযুক্ত তদন্তের উপরে বারবার জোর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এই বিষয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় বিস্তারিত সুপারিশ করেছিল মালিমাথ কমিটি। নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই সুপারিশের বিষয়গুলি মাথায় রেখে বৃহত্তর জনস্বার্থে আইন সংশোধন করবে বলে আশা করেছিলেন আইনজীবীরা। কিন্তু উল্টে নয়া আইনগুলি হয়েছে দমনমূলক।

দেখা গেল, নয়া আইনে পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ বা ৬০ দিন করা হয়েছে। ফলে হেফাজতে অত্যাচার ও হেনস্থা করার জন্য ৪ বা ৬ গুণ বেশি সময় পাবে পুলিশ। পাশাপাশি হেফাজতের মেয়াদ বাড়ানো হলে সেই সময়কালে অভিযুক্তেরা জামিনও পাবেন না। বদলাবে পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি। হেফাজতে অত্যাচার ও হেনস্থা রুখতে আদালতের তৈরি ব্যবস্থা কাজ করবে না।

আইনজীবীরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন হাতকড়ার ব্যবহার নিয়ে। নয়া আইনে কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে হাতকড়া পরানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একাধিক মামলায় হাতকড়া পরানোকে অমানবিক ও সংবিধান-বিরোধী অ্যাখ্যা দিয়েছিল আদালত। পুরনো আইনে একা বন্দি রাখার ব্যবস্থাকে ‘বর্বর’ ও ‘অসভ্য’ অ্যাখ্যা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু নয়া আইনে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা আইনজীবীদের মতে সংবিধান-বিরোধী।

কয়েকটি লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে সামাজিক কাজের (কমিউনিটি সার্ভিস) বিধান রয়েছে নয়া আইনে। কিন্তু সামাজিক কাজের সংজ্ঞা নয়া আইনে নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে কাউকে যদি রাস্তা বা প্রকাশ্য শৌচাগার পরিষ্কার করতে বলা হয় তবে তা মানবিক মর্যাদার বিরোধী বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

সংগঠিত অপরাধ রোধে নয়া আইনে একটি ধারা রাখা হয়েছে। কিন্তু দিল্লি বার কাউন্সিলের সদস্যদের বক্তব্য, এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলায় বিশেষ আইন রয়েছে। তাই এই ধারার প্রয়োজন নেই। আবার গণপিটুনিতে খুন রুখতে নতুন আইনে রয়েছে আলাদা ধারা। চিঠিতে আইনজীবীদের প্রশ্ন, হত্যার ক্ষেত্রে আলাদা ধারার প্রয়োজন কী?

নয়া আইনের অন্য একটি ধারায় পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি ব্যক্তির জমায়েতকে বেআইনি তকমা দেওয়া হয়েছে। সেই ধারায় পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি ব্যক্তির দ্বারা খুনের ক্ষেত্রে আলাদা শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আশঙ্কা, এই ধারা ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ সভা-মিছিল বন্ধ করে দিতে পারে প্রশাসন।

জঙ্গি কার্যকলাপ রুখতে তৈরি আইন টাডা ও পোটা বাতিল করতে হয়েছিল। কিন্তু বার কাউন্সিল সদস্যদের মতে, নয়া আইনে ফের সেই আইনে থাকা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। বার কাউন্সিল সদস্যদের আরও বক্তব্য, আগের আইনে থাকা রাষ্ট্রদ্রোহের ধারাকে নয়া আইনে আরও কড়া করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনে ভুয়ো বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ রোধের জন্য থাকা ধারার প্রবল অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মত তাঁদের।

মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে এমন ধারার সংখ্যা বাড়ানো, ফৌজদারি মামলায় ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিচার ও প্রমাণ পেশের ক্ষেত্রেও নয়া আইনের বিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আইনের শাসনের মূল কথা হল স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে বিচার। হেনস্থা নয়। কিন্তু সংশোধিত আইনে সেই বিচারের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। কোনও সভ্য দেশে পুলিশকে এত ক্ষমতা দেওয়া যায় না।’’

জ্ঞানতোষ প্রামাণিক, ঘোড়াদল, দক্ষিণ ২৪ পরগণা