গণদাবী ৭৭ বর্ষ ২০ সংখ্যায় ‘কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার ৭০ শতাংশ কর্মচারী’ শীর্ষক প্রবন্ধে বর্তমানে তথাকথিত ‘হোয়াইট কলার’ কর্মচারীদের উপর যে কর্মক্ষেত্রের চাপ, মানসিক পীড়ন, হতাশা, চাকরি হারানোর আশঙ্কা কাজ করে, তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কাজের ঘণ্টার যে কী ভয়াবহ অবস্থা, আমি একজন চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে কিছুটা জানি। এর সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যানেজমেন্টে কর্মরত বন্ধুদের অবস্থা কিছুটা অনুভব করে আমার অভিজ্ঞতা লেখার চেষ্টা করছি।
এই হয়রানি ট্রেনি জীবনের গোড়া থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। প্রথম বর্ষের ট্রেনিদের উপর অপেক্ষাকৃত সিনিয়রদের চাপসৃষ্টির একটা পর্ব চলে। বাস্তবে এই সিনিয়র ট্রেনিরাও একই রকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু চাপ নিবারণের জন্য চেষ্টা না করে তা অন্যের ঘাড়ে স্থানান্তরের ফল কী দাঁড়ায়?
এর ফলে প্রথম বর্ষের নতুন ট্রেনিরা চূড়ান্ত হতাশ, বিরক্ত, কাজের ভারে ন্যূব্জ-কুব্জ হয়ে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর যারা ভেবেছিল ‘এবার রেহাই পেলাম’, সেই সিনিয়ররাও অন্যান্য বিভিন্ন রকম বিষয়ের মাকড়সার জালে জড়িয়ে যায়। যে সব সাধারণ মানুষ এই সমস্ত ট্রেনিদের থেকে পরিষেবা পেতে পারতেন এবং ট্রেনিরাও এই পরিষেবা দিতে পেরে খুশি হতে পারতেন– তার কোনওটাই হতে পারে না। এই যে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, ধমকানো বা মানসিক ভাবে অত্যাচার করার প্রবণতা, তার কারণ হিসাবে আমার মনে হয়, প্রফেশনাল কোর্সগুলোর ভিতরে যে নৈতিকতা, মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ, আদর্শ রয়েছে, সেখান থেকে আমাদের বহু দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার সামাজিক-মানবিক দিকগুলোকে সরিয়ে দিয়ে বর্তমানপুঁজিবাদী ব্যবস্থার শিক্ষাপ্রণালী শুধুমাত্র এগুলোর টেকনিক্যাল-মেকানিক্যাল দিকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কেরিয়ার-সর্বস্ব মানুষ তৈরি করছে। এই যে আদর্শহীনতা, যেভাবেই হোক কম্পিটিশনে জেতার প্রবণতা, এটা যে মানুষকে মনুষ্যত্বহীন জানোয়ারে পরিণত করে ফেলে, তা বোঝার বা বোঝানোর মতো প্রতিস্রোত বর্তমানে তৈরি করা হল সময়ের দাবি।
এই চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তার নিজের সর্বোচ্চ মুনাফার চক্করে, একদিকে বিভিন্ন উপায়ে মানুষের শ্রমশক্তি নিংড়ে নিচ্ছে– যার মর্মস্পর্শী বিবরণ বর্তমান প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে নীতি-আদর্শহীন, আত্মসর্বস্ব, বৈভবপূর্ণ জীবনের, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মোহের মধ্যে যুবক-যুবতীদের আটকে ফেলছে। এই সত্য আমরা যে যতটুকু বুঝতে পারছি, এই অবস্থার পরিবর্তনে তাদের প্রত্যেককে ততটুকু করে নিজের ভূমিকা নিতে হবে।
একটা নির্দিষ্ট পরিসরের সমস্ত রকম শ্রমিক– ঝাড়ূদার থেকে অফিসার যখন একটা উন্নত সংস্কৃতি চর্চা করবে, ঐক্যবদ্ধ হবে এবং বর্তমান এই চূড়ান্ত অত্যাচারী শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করতে থাকবে, সেই সময় থেকে এই অবস্থার এবং কর্মচারীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়ে যাবে।
ডাঃ ভরত দাস, দিল্লি