ইউনাইটেড আরব আমিরশাহী (ইউএই)-র দুবাইতে ইউএনএফসিসিসি-র ক্লাইমেট অফ পার্টিজ-এর (কপ ২৮, ২০২৩) ২৮তম কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আমরা জানি যে, পৃথিবীর মূল জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস। এর জন্য একদিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের আবরণ ওজন স্তর পাতলা হচ্ছে, অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মেরু প্রদেশের বরফ গলিয়ে দিচ্ছে। আর এই গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, অশোধিত খনিজ তেল ও গ্যাস প্রভৃতি) দহন থেকে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী ও শক্তিধর দেশগুলি (আমেরিকা, চিন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, জার্মানি প্রভৃতি) প্রধানত দায়ী এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ অন্যান্য সমস্ত দেশই কম বেশি দায়ী। অথচ প্রতি বছরের মতো কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনেও ওই সব দেশের প্রায় ২৫০০টি ‘জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানি’ জলবায়ু রক্ষার নাম করে বিশ্ববাজারে নিজেদের তেল ও গ্যাস ব্যবসার পসার বৃদ্ধির নির্লজ্জ বিতণ্ডা চালিয়ে গেল। এবং অবশেষে বিশ্বের বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী ও শক্তিধর দেশগুলি জীবাশ্ম জ্বালানি সমূহের ‘ফেজ আউট’ স্লোগান বাতিল করে ‘ব়্যাপিডলি ফেজ ডাউন আনঅ্যাবেটেড কোল টিল দ্য এন্ড অফ দিস সেঞ্চুরি’-কে জলবায়ু সামিটের খসড়া হিসেবে গ্রহণ করেছে।
অর্থাৎ, ওরা নিজেদের কাঁধ থেকে আগামী দিনে জলবায়ু রক্ষার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে মোটামুটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সরকারি ও বেসরকারি অর্থ জোগানে এবং গবেষণায় অনেক পিছিয়ে আছে। তাই এই দেশগুলি যদি সৎ ভাবে চেষ্টাও করে তাহলেও কার্যকরী ভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, এরপর সেই খসড়ায় বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী ও শক্তিধর দেশগুলি ঘোষণা করেছে যে, ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও উৎপাদন এমন ভাবে কমাতে হবে যাতে আগামী ২০৫০ পর্যন্ত কার্বন নির্গমন শূন্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় এবং পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে না যায় তা বজায় রাখা। অর্থাৎ বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী ও শক্তিধর দেশগুলি ২০৫০ পর্যন্ত খনিজ তেল ও গ্যাসের ব্যবসা যাতে নিশ্চিন্তে চালাতে পারে তার পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা করা হল।
তবে আশার কথা, দেশে দেশে, এমনকি খোদ সম্মেলন প্রাঙ্গণে মুনাফালোভী সাম্রাজ্যবাদীদের এই নির্মম ও নির্লজ্জ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের উৎপাদনের দখলের জন্য এই সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদসৃষ্ট নৃশংস যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং পৃথিবীর সার্বিক জলবায়ু রক্ষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে সবার নজর কেড়েছে প্রবাসী ভারতীয় মণিপুরের কিশোরী লিসিপ্রিয়া কাংজাম। ১১ ডিসেম্বর সম্মেলনের অধিবেশনে পোস্টার হাতে মাত্র ১২ বছর বয়সী লিসিপ্রিয়া জলবায়ু রক্ষা কর্মী হিসেবে প্রতিবাদ জানায়। তার পোস্টার কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর বাইরে এসে ছোট্ট লিসিপ্রিয়া সাংবাদিকদের বলে যে আমার থেকে ছোট ও আমার বয়সী শিশু সহ আমরা সবাই যাতে বিশুদ্ধ বায়ুতে শ্বাস নিতে পারি, বিশুদ্ধ পানীয় জল পান করতে পারি এবং বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পৃথিবীতে বাঁচতে পারি, তার জন্যই আমার এই প্রতিবাদ। আমি চাই আন্তর্জাতিক নেতারা বিশ্ব জুড়ে ঘটে চলা যুদ্ধ বন্ধ করুক এবং পৃথিবীর জলবায়ু রক্ষার্থে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ হোক। তার পোস্টারে লেখা ছিলঃ ‘এন্ড ফসিল ফুয়েল, সেভ আওয়ার প্ল্যানেট অ্যান্ড আরও ফিউচার’।
আসুন, লিসিপ্রিয়াদের মতো বিশ্বের সমস্ত শিশুকে দূষিত জলবায়ু ও এই দূষণের জন্য দায়ী মুনাফালোভী, যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য লড়াইয়ে সামিল হই।
ডাঃ দীপক কুমার গিরি
বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর