তন্দুরির উনুনের মতো সূর্যটা সে দিন জ্বলে উঠেছিল সকাল থেকেই। জরুরি কাজে কলকাতায় যেতেই হবে।তাই হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রেনটা ধরতে হল।ফাঁকাই লাগছে ট্রেনটা, প্রচণ্ড গরম বলেই হয়তো।
আরে ওই তো একটা সিট। বসেই টের পেলাম– যেন উত্তপ্ত চাটু। উরে বাবা! আমার চোখ-মুখ দেখে সহযাত্রীদের একজন বললেন, ক’দিন ধরে এ ভাবেই যাচ্ছি দাদা। কী করব বলুন, পেটের দায়! কথা চলতে চলতে ট্রেনটা থামল নৈহাটিতে। পলকেই জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ল চা ভরতি প্লাস্টিকের গ্লাস আর কাগজের চারটে কাপ– পল্টুদা, মাসকাবারি–। কথাটা আর এগোতে পারল না। একটা ছেলে কামরায় চিৎকার করে বলে উঠল, আমরা আপনাদের কাছে কিছু কথা বলতে এসেছি– সামনে নির্বাচন।
সব যাত্রী অবাক, কী বলবে ছেলেটা?একবার ভাল করে নজর দিয়ে দেখলাম– ও একা নয়, একটি মেয়ে আর দু-জন ছেলে। কিছু কাগজ, বই তাঁদের হাতে।
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। বলে চলল ছেলেটা, সব দলকে হারিয়ে আমাদের দলকে ক্ষমতায় আনুন এ কথা বলতে আসিনি আমরা। আমরা, আমাদের পূর্বপুরুষরা ’৫২ সাল থেকে কতবার ভোট দিলাম? জিততে পেরেছি কোনও বার!
আবার সেই বক্তৃতা–ভেবে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম বটে, কিন্তু চোখ গিয়ে পড়ল ছেলেটার উপর–মাঝারি বয়স, পরিষ্কার করে দাড়ি-গোঁফ কামানো। ফিটফাট। যেন অলিন্দ যুদ্ধের বিনয় বোস।
আশ্চর্য, এ আবার কেমন ভোটের বক্তৃতা– চুরির কথা নেই, ডাকাতির কথা নেই, গালিগালাজ নেই, অন্যকে দোষারোপ নেই!
আপনারা একটু ভাবুন। দর দর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে কপাল থেকে মুখে। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়েই আবার শুরু করল, আচ্ছা, আমাদের কি জেতার কোনও রাস্তা নেই?যতবার ভোট দিচ্ছি জিতছে কারা? মালিকরা, পুঁজিপতিরা। কারণ যে রংয়েই বোতাম টিপি না কেন তারা তো সকলেই প্রভুদের সেবায় নিবেদিত। তাই ৯৯ শতাংশ মানুষ আমরা বারে বারে হারছি।
তা হলে জিতব কী করে?লড়াই করে। লড়াই ছাড়া আমরা কোনও দিন কোনও দাবি আদায় করতে পেরেছি?তাই আমাদের লড়াইয়ে নামতেই হবে। এই কারণেই লড়াইয়ের পার্টিকে শক্তিশালী করা ছাড়া জনগণের জেতার অন্য কোনও পথ নেই। এক নিশ্বাসে বলে গেল ছেলেটা।আর আমরা? মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছেলেটার দিকে।
হঠাৎ একজন যাত্রী বলে উঠল, খুব তো বড় বড় কথা বলছ ভাই, ভোটের আগে অনেকেই লড়াইয়ের কথা বলে, গদিতে গিয়েই ভুলে যায়।
ছেলেটা ঘাম ভাল করে মুছে ধীর ভাবে বলল–ঠিক বলেছেন, তাই আসল-নকলও চিনে নিতে হবে আমাদেরই। টাকা-পয়সা বুঝে নিতে আসল নকল চিনে নিই না?আলু-পটল কিনতে গেলেও কি ভাল-খারাপ বাছি না?তখন কি বলি, ও-সব বিচার করে কী হবে?
এ সবের মতো সঠিক দলকেও চিনতে হবে, তা না হলে আমরা জিতব কী করে?
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি সবাই।
কিছুক্ষণ হল ওরা ট্রেন থেকে নেমে গেছে। কিন্তু ওদের কথাগুলো মাথা থেকে নামছে না কিছুতেই।
আসল-নকল চিনতে হবে। চিনতেই হবে আমাদের।