ভোটের পর জনপ্রতিনিধির দেখা না পাওয়ার অভিযোগ যতই উঠুক, ভোট মরশুমে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সকলে কি পরিশ্রমটাই না করছেন! সকলেই চাইছেন যত দ্রুত সম্ভব যত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে। কেউ রাস্তায় মাইলের পর মাইল হাঁটছেন, কেউ মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন তো কেউ মসজিদে, দরগায় মাথা ঠুকছেন। কেউ দলিত আদিবাসী বাড়িতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সারছেন, কেউ কীর্তনের তালে নাচছেন, আবার কেউ গান ধরছেন। সকলেই চাইছেন ছলে বলে কৌশলে ভোট বৈতরণী পার হতে।
দেশের শাসক শ্রেণি এবং তাদের তল্পিবাহক গণমাধ্যমগুলো যাদের জনপ্রতিনিধি সাজিয়ে দেশের জনগণের সামনে ভোটপ্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করছে, যথার্থই কি তারা সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব চাষি, খেতমজুর, কারখানার শ্রমিক, মুটে-মজুরের প্রতিনিধি? অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রী কিংবা চাকরি না পাওয়া বেকার যুবক-যুবতীর প্রতিনিধি? সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণা কি তারা অনুভব করেন?
সম্প্রতি অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস-এর এক তথ্য থেকে জানা যায় ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জয়ী ৫৪২ জন সাংসদের ৪৭৫ জনই কোটিপতি। এদের মধ্যে ২৫ জন এমন সাংসদও আছেন যাদের সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি বা তার বেশি। যে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের দৈনিক গড় আয় ১৩০ টাকা, ৩০ শতাংশ মানুষের দৈনিক গড় আয় ৮০ টাকা, সেই দেশের ৫৪২ সাংসদের ৪৭৫ জনই কোটিপতি– এর থেকে বড় প্রবঞ্চনা, এর থেকে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে। যে সাংসদের সম্পত্তির পরিমাণ ১৫ কোটি, ৩০ কোটি, ১০০ কোটি কিংবা তারও বেশি, তিনি কি পারবেন একজন শবর মা, অনাহারে অপুষ্টিতে যার শরীর এতটাই ভেঙে পড়েছে যে নিজের শিশু সন্তানকে স্তন্য পান করাতেও অক্ষম, তার সত্যিকার প্রতিনিধি হয়ে উঠতে? এক অজ্ঞাত পরিচয় ভাগচাষি রহিম মিয়ার প্রতিনিধি হতে, ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথই যার শেষ অবলম্বন! পারবেন সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত দ্বীপের সেই আশাকর্মীর প্রতিনিধি হতে? পারবেন সেই সিভিক ভলেন্টিয়ারের প্রতিনিধি হতে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা খরচ যোগাতে যে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে? পারবেন বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই কারখানার শ্রমিকের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে? যার পরিবারের মা-বোনেদের অন্ধকারে ছায়ামূর্তি হয়ে দাঁড়াতে হয় দু’বেলা পেট চালাতে। পারবেন সেই গিগ শ্রমিকদের প্রতিনিধি হতে, যাদের একটা বড় অংশ জোমাটো, স্যুইগি, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজনের অনলাইন ডেলিভারি বয় হিসেবে মাইলের পর মাইল দৌড়ে বেড়াচ্ছে পরিবার প্রতিপালন করতে, যাদের সংখ্যা দেশ জুড়ে কয়েক লক্ষ, তাদের প্রতিনিধি হতে? পারবেন কি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতিনিধি হতে? বেঁচে থাকার লড়াইতে টিকে থাকতে যাদের পাড়ি দিতে হয় গ্রাম থেকে শহরে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, ভিন্ রাজ্যে এমনকি বাইরের দেশে। দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে জীবনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে যারা দিবারাত্রি কাজ করে চলেছে নির্মাণ শিল্পে, ছোট ছোট কলকারখানায়, পরিবহণ ক্ষেত্রে। যাদের দুর্দশার চিত্র কার্যত অবর্ণনীয়। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক এই সাংসদরা কি পারবেন দেশের অসংখ্য নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের যথার্থ প্রতিনিধি হয়ে উঠতে? এক কথায় উত্তর– না। এরপরও শাসকশ্রেণি ও তাদের পেটোয়া গণমাধ্যম সাধারণ জনগণকে সেই পাঠ পড়াবে যাতে করে তাদের মনে হয় অমুক দলকে সরিয়ে তমুক দলকে আনলে, অমুক নেতাকে সরিয়ে তমুক নেতাকে ভোটে জেতালে তাদের সমস্যার সমাধান হবে, অবস্থার পরিবর্তন হবে। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনের নামে এ এক আশ্চর্য মায়াজাল! এই মায়াজাল ছিন্ন করতে চাই রাজনৈতিক সচেতনতা, চাই স্পষ্ট বুঝে নেওয়া, কে সত্যিকারের শোষিত মানুষের প্রতিনিধি। যত দিন তা ধরতে বুঝতে না পারা যাবে, ততদিন গণতন্ত্রের নামে শোষিত মানুষের শত্রু যারা, তারাই বারে বারে জয়ী হবে।
জিশু সামন্ত, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা-৪৭