মাসখানেক আগের কথা। পাড়ার নার্সারি স্কুলে মেয়েকে আনতে গেছি। কানে এল দুই মায়ের কথোপকথন। একজন বলছেন, ‘শুনেছ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নাকি বন্ধ করে দেবে’? অন্যজন উত্তর দিলেন, ‘দিক। আমরা আগে বিচার চাই।’ মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল। আর জি করের নির্যাতিতার সুবিচারের দাবিতে আন্দোলন শহুরে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের আন্দোলন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে এই আন্দোলন স্পর্শ করেনি, এ সব কথা প্রায়শই উঠে আসে সংবাদপত্র-সমাজমাধ্যম-তর্কবিতর্কে। কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা মাসের পর মাস ঢুকছে যে সংসারে, তেমন এক মা যখন নির্দ্ধিধায় সেই হাজার টাকার চেয়ে ন্যায়বিচারকে অনেক বেশি জরুরি মনে করছেন, তখন বোঝা যায় এই ভয়াবহ ঘটনার যন্ত্রণা কত গভীরে স্পর্শ করেছে তাঁদের।
আরেকটি অভিজ্ঞতা ৪ সেপ্টেম্বর রাতের। জুনিয়র ডাক্তাররা সে দিন ঘরে ঘরে আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালাবার আহ্বান রেখেছিলেন, আবার বহু জায়গায় রাতের রাজপথে জমায়েত করে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন নাগরিক সমাজ। তেমনই একটি জমায়েত থেকে ফেরার পথে দেখেছিলাম, অন্ধকার বস্তির সামনে ভাঙা পাঁচিলে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়েছেন এক বাবা, সাথে দুই কচি মেয়ে। ওই নির্জন রাতে তিনজনে মিলেই গলা তুলেছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ আন্দোলনরত ডাক্তারদের অভিজ্ঞতায় শুনেছি, এক হাতপাখা বিক্রেতা দিনের পর দিন অনশন মঞ্চে যেতেন, জুনিয়র ডাক্তারদের হাওয়া করতেন, তখন মনে হয় এই আন্দোলনের আবেগ শুধু শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে আটকে ছিল– এমনভাবে ভাবা বা দেখা অসম্পূর্ণ। কাজেই শহরে, মফঃস্বলে যখন আরজিকরের সুবিচার চেয়ে মানুষ পথে নেমেছেন, সেই জনস্রোতে কোথাও পিছনে, কোথাও সামনে, কোথাও হয়তো আড়ালে মিশে থেকেছেন এই মানুষগুলো, যাঁরা প্রতিদিনের জীবনযন্ত্রণা, ক্রমশ দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার অসহায়তার সাথে মিলিয়ে অনুভব করেছেন এই ঘটনার অভিঘাতকে। আন্দোলনের প্রবাহে আর জি করের সাথে জুড়ে গেছে জয়নগর, কৃষ্ণনগরের নামও। হাথরাসের নির্যাতিতার দাদাও এই যন্ত্রণা অনুভব করেই বলেছেন, ‘তাঁর বোন যে বিচার পায়নি, অভয়া যেন সেই বিচার পায়।’
এ কথা ঠিক, মানুষ যা চেয়েছিলেন, সেই বিচার মেলেনি আজও। প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে কিনা, এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর কারও জানা নেই। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার শুনানি দিনের পর দিন বিলম্বিত করা, সিবিআই চার্জশিটে শুধুমাত্র সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করে কলকাতা পুলিশের তদন্তে সিলমোহর দেওয়া, আরজিকর থেকে অপসারিত থ্রেট কালচারের মাথাদের তৃণমূল সরকারের তৎপরতায় আবার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা, এসব দেখে মানুষ সঙ্গত কারণেই কিছুটা আশাহত। কিন্তু এই হতাশার দীর্ঘশ্বাস যেন দীর্ঘ তিন মাস ধরে চলা আন্দোলনের উজ্জ্বল অর্জনকে আড়াল করতে না পারে, সে দায়িত্ব বর্তায় সচেতন নাগরিক সমাজের ওপরেই। ৯ আগস্ট সকালে ঘটনা কোন দিকে এগোবে, আদৌ তদন্ত হবে কি না এসব কিছুই জুনিয়র ডাক্তাররা জানতেন না। তবু সেই মুহূর্তে এই ভয়াবহ ঘটনার বিচার চেয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে তারা অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের অপসারণ দাবি করেছেন, মৃতদেহের ময়না তদন্ত এবং ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। সাধারণ মানুষও এই আন্দোলনের পাশে থেকেছেন গতানুগতিক নিরুপদ্রব জীবন উপেক্ষা করেই। সন্দীপ ঘোষের অপসারণ, অপরাধীদের আড়াল করতে সচেষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের গ্রেপ্তারের মতো যে ক’টি দাবি মানতে রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছে, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শাসকের প্রশ্রয়ে যে থ্রেট কালচারের রমরমা সামনে এসেছে, সেটুকুও হত না এই লাগাতার আন্দোলনের চাপ ছাড়া। আর জি করের আন্দোলন মানুষকে বহুদিনের স্থবিরতা ভেঙে রাজপথে নামতে শেখালো, দলে দলে সাধারণ মানুষ একটি আপাত অপরিচিত মেয়ের যন্ত্রণা বুকে বহন করে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন। রাজ্যে রাজ্যে, গোটা দেশ জুড়ে নারীর নির্যাতন-অবমাননাকে মদত দিচ্ছে যে সরকার-প্রশাসন, মানুষকে অমানুষে পরিণত করে ধর্ষকের জন্ম দিচ্ছে যে অসুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা, আঙুল উঠল তার দিকেও।
অভয়ার বিচার চেয়ে এ ভাবেই নিজের বৃত্তের বাইরে গিয়ে ন্যায়ের জন্য সোচ্চার হতে শিখলেন মানুষ। ‘আন্দোলন করে কিছু হয় না,’– এই চলতি মানসিকতার বিপরীতে গিয়ে মানুষ প্রতিবাদে পথে নামলেন এবং অনুভব করলেন, এক মাত্র সংগঠিত প্রতিবাদের পথেই কিছু হতে পারে। আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন এখানেই।
সূর্যস্নাতা সেন, কলকাতা-৭৭