সময় বদলায়, শাসক বদলায়, দলবদল হয়, কিন্তু শাসকের চরিত্রের বদল হয় না। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার এ এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়, পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় সিপিএম-ফ্রন্ট সরকার। একদিন মধ্যরাতে পুলিশ ও কলকাতা করপোরেশনের যৌথ নেতৃত্বে শুরু হয় শহরের একুশটি রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদ অভিযান। রাতভর অভিযানে গড়িয়াহাট, লেক মার্কেট, কালীঘাট, হাতিবাগান, বিধান সরণি, ধর্মতলা, ডায়মন্ডহারবার রোডের একের পর এক হকারের স্টল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বুলডোজারের আঘাতে। রুজি-রুটি হারা হন কয়েক হাজার হকার। কলকাতার ইতিহাসে এই ঘটনা কুখ্যাত ‘অপারেশন সানসাইন’ নামে পরিচিত।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, রাজনৈতিক পালাবদলের সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা। রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় এখন তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু হকার উচ্ছেদ নিয়ে সরকারি নীতির পরিবর্তন হয়নি। এই ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হল পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সরকার বদলালেই, মানুষের সমস্যার সমাধান হয় না।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর শহর জুড়ে শুরু হয়েছে হকার উচ্ছেদ অভিযান। একদিকে সরকার, পুলিশ-প্রশাসন আর অন্যদিকে গরিব, অসহায় হকার। অভিযোগ–বেআইনি ভাবে ফুটপাত জবরদখল করে আছে হকাররা। অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে পথচলতি মানুষদের। কলকাতার সৌন্দর্যায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে হকাররা, বড় বড় উড়ালপুল, শপিংমল, আর বাতিস্তম্ভের ভিড়ে তারা বড়ই বেমানান। তাই গত কয়েক দিনে কোনও রকম বিজ্ঞপ্তি ছাড়া, কোনও রকম পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি ছাড়া, বুলডোজার চালিয়ে ভাঙা হয়েছে একের পর এক হকারের স্টল। রুজি-রুটির শেষ সম্বলটুকু হারালেন হাজার হাজার হকার। সাথে সাথে এই হকারদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের মানুষগুলোর উপর হঠাৎই নেমে এল অনিচয়তারগভীরঅন্ধকার।
কোনও সচেতন নাগরিক ফুটপাত জবরদখল সমর্থন করে না। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে, কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসহায় মানুষগুলো ফুটপাতে দোকান খুলতে বাধ্য হয়েছে সে কথাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। সারা দেশ জুড়ে হাজার হাজার বেকার, একের পর এক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ছাঁটাই, লে-অফ রোজকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমাদের রাজ্যের চিত্রটাও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে গরিব মানুষের কাছে হকারি করা ছাড়া, সৎ পথে উপার্জনের আর কোনও বিকল্প সুযোগ কী আছে? ফলে একে আইনি সমস্যা বলা ভুল, এ এক মানবিক সমস্যা।
সরকার যখন কাজ দিতে পারছে না তখন হাজার হাজার মানুষ দু’মুঠো খাবারের জোগাড় করতে ফুটপাতে দোকানপাট করলে তাকে মানবিক দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। উচ্ছেদের প্রয়োজন হলে আগে পুনর্বাসন দিয়েই করতে হবে। দেশের নাগরিকদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনও অজুহাতেই এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে হকার উচ্ছেদ আইনবিরুদ্ধ, অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক।
তাই ‘হকার আইন ২০১৪’ অনুযায়ী উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবিতে এবং কোনও রকম বিজ্ঞপ্তি ছাড়া সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ভাবে হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে সঠিক নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী হকার আন্দোলনের পাশে সমস্ত পেশার খেটে-খাওয়া মানুষকে দাঁড়াতেই হবে।
সৌভিক সামন্ত
খানাকুল, হুগলি