‘যতই কাদা ছুঁড়িবেন ততই পদ্ম ফুটিবে’, উবাচ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি– ক্রমশই যিনি দেশের প্রশাসনিক প্রধানের করণীয় তুচ্ছ পার্থিব দায়িত্ব হইতে উন্নীত হইয়া গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত বাণী বিতরণকারী সাধুমহাত্মার ভাবমূর্তি ধারণ করিয়াছেন। ভেক যত আড়ম্বরপূর্ণ হইতেছে, দেশে কোনও জনজীবন তোলপাড় করিবার মতো ঘটনা ঘটিলেই তিনি ততই মৌনীবাবার ভূমিকায় অপ্রাসঙ্গিক বাণী ছাড়িতেছেন। এমনিতেই গত বছর দশেক ধরিয়া তিনিই বর্তমান ভারতাত্মার স্বঘোষিত মূর্ত প্রতীক হইয়া উঠিতেছেন বলিলেই হয়। তাঁহার কথা মাত্রেই বেদবাক্য– যাহার প্রতিবাদ করিলেই পাকিস্তানে বা কারান্তরালে যাইতে হইবে। পদ্ম প্রসঙ্গে তো কথাই নাই। পদ্ম যে পঙ্কেই জন্মে এবং তাই তাহার নাম ‘পঙ্কজ’, তাহা মোদিজি এবং তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ভালোই বুঝেন এবং দেশবাসীকে তাঁহারা প্রতিনিয়তই তাহা হাড়ে হাড়ে বুঝাইয়া ছাড়িতেছেন। সারা দেশ জুড়িয়া প্রতিনিয়ত তাঁহারা রাশি রাশি পাঁক ছিটাইতেছেন। কিন্তু প্রস্ফূটিত পদ্মের আঘ্রাণ আস্বাদনের সম্ভাবনা তাহাতে নাই।
কারণ তাঁহাদের পদ্ম শুধু ভোটের পঙ্কেই ফোটে। কখনও সে পাঁকের নাম উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং মুসলিমবিদ্বেষ। সাধুজির শাগরেদ নাম্বার ওয়ান মুসলিম নারীদের কঙ্কাল কবর হইতে তুলিয়া ধর্ষণ করিবার বিধান দিয়াছেন। কখনও পাঁকের নাম দলিত বলিয়াই কাহাকেও নির্যাতন, দলিতকন্যাকে ধর্ষণ করিয়া পুড়াইয়া মারা। কখনও পাঁকের নাম খ্রিস্টান সন্ন্যাসীকে সপুত্র পুড়াইয়া হত্যা, কখনও বা নাম এনআরসি করিয়া যাহার তাহার গায়ে বিদেশি লেবেল সাঁটিয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে পচাইয়া মারা। কখনও পাঁকের নাম বুলডোজার চালাইয়া নারীশিশু সমেত নাগরিকের ঘরবাড়ি গুঁড়াইয়া দেওয়া, পিষিয়া মারা। আবার কখনও প্রতিবাদী আন্দোলনকারী, সাংবাদিক বা সমাজকর্মীদের ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘আরবান নকশাল’ বা যাহা খুশি নাম দিয়া বিনাবিচারে জেলে আটক করিয়া, বিনা চিকিৎসায় মারিয়া ফেলা বা সরাসরি গুণ্ডা লাগাইয়া গুলি করিয়া হত্যা করা। কখনও সে পাঁক গোরক্ষার হুজুগ তুলিয়া সাধারণ গোপালক গ্রামবাসীকে মারধর হত্যা, লোকের ঘরে ঢুকিয়া গোমাংসের সন্ধানে ছারখার করা। কখনও বা পাঁকের নাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ধর্ষক খুনিকে ‘ধার্মিক’ সার্টিফিকেট দিয়া জেল হইতে ছাড়াইয়া আনিয়া মাল্যচন্দন দিয়া বরণ করা, আবার শেয়ার মার্কেটে জালিয়াতি করা ঘনিষ্ঠ শিল্পপতির বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটিয়া থাকা এবং ‘এমনটা তো হয়েই থাকে’ গোছের মুখ করিয়া ছবি দেওয়া।
বলিতে কি, সাধুবাবার চেলাদের সুকীর্তির সংখ্যা এতই যে তালিকা করিতে গেলে কাগজের পাতায় কুলাইবে না, বেশ কয়েক জিবি মেমরি সম্পন্ন পেনড্রাইভ চাই। পাঁক ছুটিতেছে এবং পদ্মও ফুটিতেছে সন্দেহ নাই। তবে কিনা পাঁকের গন্ধেই দেশ ম ম করিতেছে, পদ্মের সুগন্ধ নাই। পঙ্ক তাই উৎসাহিত হইয়া দেশের সীমা ছাড়িয়া ইদানিং বহির্বিশ্বেও ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে। ইজরায়েলের চিত্র সমালোচক ‘কাশ্মীর ফাইলস’কে মন্দ বলিয়াছেন। অতএব ইজরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে চাপ দিয়া তাঁহার সমালোচনা করিয়া দেশে ফেরানো হইল। বিবিসি গুজরাটে সাধুবাবার অপকর্ম দেখাইয়া চিত্র করিয়াছে। অতএব সে ছবি নিষিদ্ধ এবং বিবিসির অফিসে আয়কর হানা। সকলই নিয়মমতো চলিতেছে। তবে বিদ্বেষের পাঁক ছিটাইয়া শেষ অবধি পৃথিবীতে কেহই রক্ষা পান নাই। ইতিহাস সে কথাই বলে। পঙ্কজপ্রিয় এবং তাঁহার সাঙ্গপাঙ্গদের বিদ্বেষপঙ্ক ছিটাইবার রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশবিদেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিস্বর শোনা যাইতেছে– ইহাই আশার কথা।