দেশের হয়ে যাঁরা আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন, সেই মহিলা কুস্তিগিররা আন্দোলনে নেমেছেন তাঁদের উপর চলা যৌন হয়রানির প্রতিকার এবং দোষীদের শাস্তি চেয়ে। তাঁদের অভিযোগ রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (ডব্লিউএফআই) সভাপতি এবং বিজেপির বাহুবলী সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধেই। এই আন্দোলনে এখন উত্তাল ক্রীড়াজগত। তাঁদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে ডব্লিউএফআই-এর সভাপতি ও কিছু কোচ মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতদের মধ্যে নাবালিকাও রয়েছে।
প্রতিবাদকারী কুস্তিগিরদের মধ্যে কারা রয়েছেন? অলিম্পিক পদকজয়ী বজরং পুনিয়া, কমনওয়েলথ গেমসে তিনবার স্বর্ণপদকজয়ী বিনেশ ফোগট, রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ী সাক্ষী মালিক সহ প্রায় শ’দুয়েক প্রথম সারির পুরুষ ও মহিলা কুস্তিগির। বিনেশ ফোগট যন্তর মন্তরে ধরনা মঞ্চে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, জাতীয় ক্যাম্পে থাকাকালীন যৌন নির্যাতনের মুখে পড়েছেন এমন অন্তত দশ-বিশ জন মেয়ে আমার কাছে এসে তাঁদের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা এসব মেয়েদের রুটি-রুজির একমাত্র ভরসা এই রেসলিং। সাসপেন্ড করা হবে, প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হবে না বা খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়ে যে কোনও দিন ডোপিং-এর অভিযোগে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে এই ভয়ে রেসলাররা রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেন না, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন না।
কিন্তু একসময় অত্যাচারের বাঁধ ভেঙে মানুষ প্রতিবাদী হয়। আজ তাই ঘটেছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নির্যাতিতা হতে হতে মহিলা ক্রীড়াবিদরা আজ সোচ্চার হয়েছেন। সমস্ত ভয়কে জয় করে তাদের বিরুদ্ধে ঘটা অত্যাচারের কাহিনি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটার কপিল দেব থেকে শুরু করে বীরেন্দ্র সেহবাগ, নীরজ চোপড়া, অভিবন বিন্দ্রার মতো ভারতের বিখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা সনু সুদ প্রকাশ্যে আন্দোলনরত মহিলা কুস্তিগিরদের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। ধরনা স্থলে গিয়ে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এসেছেন সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডিএসও, যুব সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডিওয়াইও এবং মহিলা সংগঠন এআইএমএসএস। সারা দেশ জুড়ে ক্লাব, প্রতিষ্ঠান বিশিষ্ট নাগরিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে মিটিং মিছিল সভা হয়েছে এই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। এগিয়ে এসেছে স্কিম ওয়ার্কারদের সর্বভারতীয় সংগঠন। সকলের দাবি– ন্যায়বিচার চাই, দোষীদের শাস্তি চাই।
বছর কয়েক আগে অলিম্পিক ব্রোঞ্জ মেডেলিস্ট কর্ণম মালেশ্বরি বলেছিলেন, ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদরা শুধুমাত্র কোচদের দ্বারাই নয়, ফেডারেশনের আধিকারিকদের দ্বারাও যৌন হেনস্থার শিকার হন। প্রতিশ্রুতিমান বক্সার এস অমরাবতী কোচের হাতে হয়রানির জেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এ রকম ঘটনা অসংখ্য। মহিলা ক্রীড়াবিদদের বিরুদ্ধে ঘটা এই ধরনের যৌন হয়রানির বহু ঘটনা নানা কারণে সামনে আসে না। তবুও ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫টি যৌন হেনস্থার অভিযোগ স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কাছে জমা পড়ে। এর মধ্যে ২৯টি কোনও না কোনও কোচের বিরুদ্ধে। এইসব অভিযোগের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর ধরে তদন্ত চলে কিন্তু শাস্তি হয় না।
দেশজোড়া প্রবল জনমতের চাপে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ বাধ্য হয়ে বিজেপি সাংসদ ও ডব্লিউএফআই সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে অবশেষে এফআইআর করেছে। কিন্তু দেশের জনগণ সন্দিহান, মহিলা কুস্তিগিররা আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কি না! প্রচলিত আইন বলে, যৌন হয়রানি ও অত্যাচারের ক্ষেত্রে পুলিশ এফআইআর না করলে সেই পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। অথচ মহিলা কুস্তিগিররা বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশ কিছুতেই এফআইআর নিতে চায়নি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলার পরই পুলিশ এফআইআর নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তা হলে এই আইন কাদের জন্য, যেখানে দেশকে গর্বিত করা পদকজয়ী ক্রীড়াবিদরা বিচার পান না? এফআইআর হওয়া মানে তো গ্রেফতার করতে হবে। ব্রিজভূষণ যা করেছেন তাতে পেনাল কোডের ধারাও কম পড়ে যাবে। নির্যাতিতাদের মধ্যে একজন নাবালিকা আছেন। অর্থাৎ পকসো আইন অনুযায়ী তার গ্রেফতারি অবশ্যম্ভাবী। অথচ আজও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। এখনও পর্যন্ত তিনি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। বার্তা একদম পরিষ্কার– কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক এমনকি প্রভাবশালী হলেও যা খুশি তাই করা যায়।
২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর নামে চল্লিশটা এফআইআর হয়েছে। দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে টাডায় কেস আছে এবং জেলও খেটেছেন। ইনি বিজেপি করেন তাই ‘দেশদ্রোহী’ নন বরং অনেক বেশি ‘দেশপ্রেমী’! আর তাই, অতীতে ডাকাতি ও দাঙ্গার মতো মামলায় নাম জড়ালেও, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও এমনকি প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমে রবীন্দ্র সিং নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করার কথা স্বীকার করলেও দেশের আইনি ব্যবস্থা তাকে ছুঁতেও পারে না। বরং এইসব অভিযোগ নিয়েই তিনি ডব্লিউ এফ আই-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। পরিস্থিতি এটাই। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রতিটি ভাষণে দেশকে দুর্নীতি আর অপরাধমুক্ত করার কথা বলেন। তা হলে এটাই তাঁর দুর্নীতি আর অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নমুনা! অর্থনৈতিক সামাজিক পারিবারিক নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অমানুষিক লড়াই করে এই সমস্ত মহিলা ক্রীড়াবিদ উঠে আসেন। মহিলা হওয়ার জন্য প্রতি পদে অতিক্রম করতে হয় অনেক অলঙ্ঘনীয় বাধা, দিতে হয় অনেক মূল্য, নিভৃতে ঝরে অনেক চোখের জল। তারপর তাঁরা যখন সফল হন, সে কমনওয়েলথ গেমস হোক বা অলিম্পিক অথবা এশিয়ান গেমস, পদক জেতার পর মুহূর্ত অপচয় না করে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন, পদকজয়ী সফল ক্রীড়াবিদদের ডেকে ‘ঘরের মেয়ে’ বলে ছবি তুলে সংবাদমাধ্যমে তাঁর ক্রীড়াপ্রেমী ভাবমূর্তি প্রচার করেন। বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক সহ আন্দোলনরত অনেকের সঙ্গে তাঁর ছবি আজও সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সেই ক্রীড়াবিদরাই যখন তাদের প্রতি হওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিকার চান তাঁদের ‘মন কি বাত’ শোনার আর্জি জানান, প্রধানমন্ত্রী তখন নীরব থেকে অন্যায়কারীদের পাশে থাকারই বার্তা দিয়ে চলেন।
১৯৯০ সালের একটি ঘটনার কথা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই। ১৪ বছরের টেনিস খেলোয়াড় রুচিকা গীরহোত্রা তখনকার টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি হরিয়ানা পুলিশের আইজি এসপিএস রাঠোর-এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সমস্ত প্রশাসন যন্ত্র নির্যাতিতা নয়, অভিযুক্তের পাশে দাঁড়ায়। অভিযুক্তকে ডিজিপি পদে প্রোমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করে সরকার। রুচিকার পরিবারের উপর অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। সমস্ত দিক থেকে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে রুচিকা আত্মহত্যা করে। ১৯ বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর রাঠোর দোষী সাব্যস্ত হলেও বিচারে তার মাত্র ছয় মাসের জেল আর ১০০০ টাকা জরিমানা হয়। এই হচ্ছে দেশের আইনের শাসন!
বর্তমান কুস্তিগিরদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। গত জানুয়ারিতে ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর তাদের সঙ্গে দেখা করে সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু আশ্বাসই সার। কমিটির রিপোর্ট অভিযোগকারীদের পড়তে দেওয়া হয়নি। জোর করে তাদের কাছ থেকে সই নেওয়া হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, ঐ কমিটির সদস্য বিজেপি সাংসদ ববিতা ফোগট কমিটির তৈরি খসড়া রিপোর্ট পড়তে গেলে তার হাত থেকে তা কেড়ে নেওয়া হয় ও ছিঁড়ে দেওয়া হয়। সেই কমিটির রিপোর্টের কী হল, কোথায় তা পেশ করা হল, কী ঘটল কেউ তা জানল না। সরকার এবং তার পদকজয়ী মহিলাদেরও রেহাই মিলছে না বিজেপি শাসনে।দেশের হয়ে যাঁরা আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন, সেই মহিলা কুস্তিগিররা আন্দোলনে নেমেছেন তাঁদের উপর চলা যৌন হয়রানির প্রতিকার এবং দোষীদের শাস্তি চেয়ে। তাঁদের অভিযোগ রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (ডব্ল্লিউএফআই) সভাপতি এবং বিজেপির বাহুবলী সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধেই। এই আন্দোলনে এখন উত্তাল ক্রীড়াজগত। তাঁদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে ডব্ল্লিউএফআই-এর সভাপতি ও কিছু কোচ মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিতদের মধ্যে নাবালিকাও রয়েছে।
প্রতিবাদকারী কুস্তিগিরদের মধ্যে কারা রয়েছেন? অলিম্পিক পদকজয়ী বজরং পুনিয়া, কমনওয়েলথ গেমসে তিনবার স্বর্ণপদকজয়ী বিনেশ ফোগট, রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ী সাক্ষী মালিক সহ প্রায় শ’দুয়েক প্রথম সারির পুরুষ ও মহিলা কুস্তিগির। বিনেশ ফোগট যন্তর মন্তরে ধরনা মঞ্চে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, জাতীয় ক্যাম্পে থাকাকালীন যৌন নির্যাতনের মুখে পড়েছেন এমন অন্তত দশ-বিশ জন মেয়ে আমার কাছে এসে তাঁদের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা এসব মেয়েদের রুটি-রুজির একমাত্র ভরসা এই রেসলিং। সাসপেন্ড করা হবে, প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হবে না বা খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে দিয়ে যে কোনও দিন ডোপিং-এর অভিযোগে তাদের নিষিদ্ধ করা হবে এই ভয়ে রেসলাররা রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেন না, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন না।
কিন্তু একসময় অত্যাচারের বাঁধ ভেঙে মানুষ প্রতিবাদী হয়। আজ তাই ঘটেছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নির্যাতিতা হতে হতে মহিলা ক্রীড়াবিদরা আজ সোচ্চার হয়েছেন। সমস্ত ভয়কে জয় করে তাদের বিরুদ্ধে ঘটা অত্যাচারের কাহিনি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছেন। কিংবদন্তি ক্রিকেটার কপিল দেব থেকে শুরু করে বীরেন্দ্র সেহবাগ, নীরজ চোপড়া, অভিবন বিন্দ্রার মতো ভারতের বিখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা সনু সুদ প্রকাশ্যে আন্দোলনরত মহিলা কুস্তিগিরদের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। ধরনা স্থলে গিয়ে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এসেছেন সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডিএসও, যুব সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডিওয়াইও এবং মহিলা সংগঠন এআইএমএসএস। সারা দেশ জুড়ে ক্লাব, প্রতিষ্ঠান বিশিষ্ট নাগরিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে মিটিং মিছিল সভা হয়েছে এই সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। এগিয়ে এসেছে স্কিম ওয়ার্কারদের সর্বভারতীয় সংগঠন। সকলের দাবি– ন্যায়বিচার চাই, দোষীদের শাস্তি চাই।
বছর কয়েক আগে অলিম্পিক ব্রোঞ্জ মেডেলিস্ট কর্ণম মালেশ্বরি বলেছিলেন, ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদরা শুধুমাত্র কোচদের দ্বারাই নয়, ফেডারেশনের আধিকারিকদের দ্বারাও যৌন হেনস্থার শিকার হন। প্রতিশ্রুতিমান বক্সার এস অমরাবতী কোচের হাতে হয়রানির জেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। এ রকম ঘটনা অসংখ্য। মহিলা ক্রীড়াবিদদের বিরুদ্ধে ঘটা এই ধরনের যৌন হয়রানির বহু ঘটনা নানা কারণে সামনে আসে না। তবুও ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫টি যৌন হেনস্থার অভিযোগ স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার কাছে জমা পড়ে। এর মধ্যে ২৯টি কোনও না কোনও কোচের বিরুদ্ধে। এইসব অভিযোগের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর ধরে তদন্ত চলে কিন্তু শাস্তি হয় না।
দেশজোড়া প্রবল জনমতের চাপে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ বাধ্য হয়ে বিজেপি সাংসদ ও ডব্লিউএফআই সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে অবশেষে এফআইআর করেছে। কিন্তু দেশের জনগণ সন্দিহান, মহিলা কুস্তিগিররা আদৌ ন্যায়বিচার পাবেন কি না! প্রচলিত আইন বলে, যৌন হয়রানি ও অত্যাচারের ক্ষেত্রে পুলিশ এফআইআর না করলে সেই পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। অথচ মহিলা কুস্তিগিররা বারবার অভিযোগ করা সত্তে্বও দিল্লি পুলিশ কিছুতেই এফআইআর নিতে চায়নি। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তোলার পরই পুলিশ এফআইআর নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পুলিশের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তা হলে এই আইন কাদের জন্য, যেখানে দেশকে গর্বিত করা পদকজয়ী ক্রীড়াবিদরা বিচার পান না? এফআইআর হওয়া মানে তো গ্রেফতার করতে হবে। ব্রিজভূষণ যা করেছেন তাতে পেনাল কোডের ধারাও কম পড়ে যাবে। নির্যাতিতাদের মধ্যে একজন নাবালিকা আছেন। অর্থাৎ পকসো আইন অনুযায়ী তার গ্রেফতারি অবশ্যম্ভাবী। অথচ আজও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। এখনও পর্যন্ত তিনি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। বার্তা একদম পরিষ্কার– কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক এমনকি প্রভাবশালী হলেও যা খুশি তাই করা যায়।
২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর নামে চল্লিশটা এফআইআর হয়েছে। দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে টাডায় কেস আছে এবং জেলও খেটেছেন। ইনি বিজেপি করেন তাই ‘দেশদ্রোহী’ নন বরং অনেক বেশি ‘দেশপ্রেমী’! আর তাই, অতীতে ডাকাতি ও দাঙ্গার মতো মামলায় নাম জড়ালেও, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও এমনকি প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমে রবীন্দ্র সিং নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করার কথা স্বীকার করলেও দেশের আইনি ব্যবস্থা তাকে ছুঁতেও পারে না। বরং এইসব অভিযোগ নিয়েই তিনি ডব্লিউ এফ আই-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। পরিস্থিতি এটাই। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রতিটি ভাষণে দেশকে দুর্নীতি আর অপরাধমুক্ত করার কথা বলেন। তা হলে এটাই তাঁর দুর্নীতি আর অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নমুনা! অর্থনৈতিক সামাজিক পারিবারিক নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অমানুষিক লড়াই করে এই সমস্ত মহিলা ক্রীড়াবিদ উঠে আসেন। মহিলা হওয়ার জন্য প্রতি পদে অতিক্রম করতে হয় অনেক অলঙ্ঘনীয় বাধা, দিতে হয় অনেক মূল্য, নিভৃতে ঝরে অনেক চোখের জল। তারপর তাঁরা যখন সফল হন, সে কমনওয়েলথ গেমস হোক বা অলিম্পিক অথবা এশিয়ান গেমস, পদক জেতার পর মুহূর্ত অপচয় না করে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন, পদকজয়ী সফল ক্রীড়াবিদদের ডেকে ‘ঘরের মেয়ে’ বলে ছবি তুলে সংবাদ মাধ্যমে তাঁর ক্রীড়াপ্রেমী ভাবমূর্তি প্রচার করেন। বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক সহ আন্দোলনরত অনেকের সঙ্গে তাঁর ছবি আজও সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সেই ক্রীড়াবিদরাই যখন তাদের প্রতি হওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিকার চান তাঁদের ‘মন কি বাত’ শোনার আর্জি জানান, প্রধানমন্ত্রী তখন নীরব থেকে অন্যায়কারীদের পাশে থাকারই বার্তা দিয়ে চলেন।
১৯৯০ সালের একটি ঘটনার কথা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই। ১৪ বছরের টেনিস খেলোয়াড় রুচিকা গীরহোত্রা তখনকার টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি হরিয়ানা পুলিশের আইজি এসপিএস রাঠোর-এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। সেই সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সমস্ত প্রশাসন যন্ত্র নির্যাতিতা নয়, অভিযুক্তের পাশে দাঁড়ায়। অভিযুক্তকে ডিজিপি পদে প্রোমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করে সরকার। রুচিকার পরিবারের উপর অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। সমস্ত দিক থেকে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে রুচিকা আত্মহত্যা করে। ১৯ বছর ধরে আইনি লড়াইয়ের পর রাঠোর দোষী সাব্যস্ত হলেও বিচারে তার মাত্র ছয় মাসের জেল আর ১০০০ টাকা জরিমানা হয়। এই হচ্ছে দেশের আইনের শাসন!
বর্তমান কুস্তিগিরদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। গত জানুয়ারিতে ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর তাদের সঙ্গে দেখা করে সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু আশ্বাসই সার। কমিটির রিপোর্ট অভিযোগকারীদের পড়তে দেওয়া হয়নি। জোর করে তাদের কাছ থেকে সই নেওয়া হয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, ঐ কমিটির সদস্য বিজেপি সাংসদ ববিতা ফোগট কমিটির তৈরি খসড়া রিপোর্ট পড়তে গেলে তার হাত থেকে তা কেড়ে নেওয়া হয় ও ছিঁড়ে দেওয়া হয়। সেই কমিটির রিপোর্টের কী হল, কোথায় তা পেশ করা হল, কী ঘটল কেউ তা জানল না। সরকার এবং তার প্রশাসনিক ব্যবস্থার বার্তা একদম পরিষ্কার– আমরা এটাই করব। আইনের শাসনের নাম করে এই ব্যবস্থাকে যারা রক্ষা করছে, চালাচ্ছে তাদের স্বার্থে কাজ করব। নির্যাতিতা নারীর পাশে নয়, আমাদের অনুগত নারী নির্যাতনকারীর পাশে থাকব। তোমরা কী করবে করো।
ফলে আইনি সুবিচার চাওয়ার পাশাপাশি এই নির্লজ্জ স্পর্ধার জবাব দিতে হবে আন্দোলনের পথেই। সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া, সোচ্চার হওয়া, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই একমাত্র পথ। দেশের মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন রেখে সেই পথে নেমেছেন মহিলা কুস্তিগিররা। তাঁদের অভিনন্দন।প্রশাসনিক ব্যবস্থার বার্তা একদম পরিষ্কার– আমরা এটাই করব। আইনের শাসনের নাম করে এই ব্যবস্থাকে যারা রক্ষা করছে, চালাচ্ছে তাদের স্বার্থে কাজ করব। নির্যাতিতা নারীর পাশে নয়, আমাদের অনুগত নারী নির্যাতনকারীর পাশে থাকব। তোমরা কী করবে করো।
ফলে আইনি সুবিচার চাওয়ার পাশাপাশি এই নির্লজ্জ স্পর্ধার জবাব দিতে হবে আন্দোলনের পথেই। সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া, সোচ্চার হওয়া, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই একমাত্র পথ। দেশের মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন রেখে সেই পথে নেমেছেন মহিলা কুস্তিগিররা। তাঁদের অভিনন্দন।