অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যার মতোই যে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাগুলি জনজীবনকে ভয়ানক ভাবে ব্যাহত করছে পঞ্চায়েত পৌরসভা বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের দিকে তাকালে তা বোঝার কোনও উপায় নেই। সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই বিষয়গুলি নিয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য বা কর্তব্যের কথা জনসাধারণের কাছে রাখছে না। পরিবেশ ও মানবজীবনের যে পরিপূরক সম্পর্ক তা উপলব্ধি করে এ বিষয়ে ইতিবাচক দাবি তোলার ক্ষেত্রে ভোটারদের তরফ থেকেও কোনও প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না। ‘সবুজ মঞ্চ’ নামে একটি পরিবেশ সংগঠন এই দিকে রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইস্তাহার প্রকাশ করেছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপণা বিধি ২০১৬ লংঘন করে গ্রাম শহর সর্বত্র নিষিদ্ধ প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার যথেচ্ছ বাড়ছে। এগুলি পোড়ানোতে মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা জরুরি। নদী, জলাভূমি, জলাশয় সংরক্ষণের কোনও প্রচেষ্টা সরকারি তরফে লক্ষ করা যাচ্ছে না। কোথাও তীব্র জলসংকট, কোথাও নদীর গতিপথের পরিবর্তন, নদীর পাড় ভাঙন ইত্যাদি নদী-তীরবর্তী মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। নদী, জলাভূমি, জলাশয়ে পৌর আবর্জনা ছাড়াও কলকারখানার বিষাক্ত আবর্জনা, চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক চরম দূষণ তৈরি করছে। জলাভূমি, জলাশয় বুজিয়ে ফেলার প্রবণতা বাড়ছে। রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকা পর্যটনের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে। সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, সমুদ্রতটের উপর সবুজ ধ্বংস করে জোয়ার-ভাটার এলাকায় হোটেল, বাজার নির্মাণ, বালিয়াড়ি ধ্বংস, সমুদ্রতটের উপরে অপরিমিত যান চলাচল, সমুদ্র বন্দর তৈরির উদ্যোগ উপকূলের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে নষ্ট করছে। কোস্টাল রেগুলেশন জোন নোটিফিকেশন-২০১৯-এ উপকূল রক্ষার জন্য যেটুকু বিধিনিষেধ আছে তা মানা হচ্ছে না। অন্য দিকে সুন্দরবনের নদীখাড়িতে এবং সমুদ্রতট-নির্ভর ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদের আশঙ্কায় তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে।
রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ভূগর্ভের জল স্তর ক্রমাগত এবং বিপজ্জনক ভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। চাষাবাদের কাজে, গ্রামাঞ্চলে কলকারখানার কাজে ও বহুতল বাড়ির কমপ্লেক্সের বাসিন্দাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ভূগর্ভের জল তোলা হচ্ছে। ভূগর্ভের জল নিয়ে ব্যবসাও চলছে বিপুলভাবে। ‘আর ও’ নামে সাধারণ অপরিশোধিত জলই সাধারণ মানুষকে কিনে খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসডব্লুআইডি-এর অনুমতি ছাড়া ভূগর্ভের জল তোলায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রায় কোথাও তা মানা হয় না। অন্য দিকে বৃষ্টির জল ধরে রাখার উদ্যোগ বিরল। বিভিন্ন এলাকায় জলে আর্সেনিক এবং ফ্লুরাইডের উপস্থিতিও জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বনাঞ্চল ধ্বংস করে শুধু সরকারি প্রকল্প নয়, ব্যক্তিগত মালিকানায় রিসর্ট থেকে হাউজিং ক্রমশ বেড়ে চলেছে। লক্ষ লক্ষ গাছ কাটা হচ্ছে। শুধু বনাঞ্চল নয়, রাস্তা চওড়া করার নামে, ব্রিজ তৈরির নামে, হাউজিং তৈরির নামে অসংখ্য পুরনো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। জলপাইগুড়ির লাটাগুড়িতে গোরুমারা জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন পরিবেশের পক্ষে সংবেদনশীল অঞ্চলে হাউসিং কমপ্লেক্স গড়ে তুলে, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের টুর্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য লক্ষ লক্ষ গাছ কাটা হয়েছে এবং হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বহু জায়গায় রাস্তা নির্মাণ এবং ব্রিজ নির্মাণের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে অসংখ্য গাছ। উত্তরবঙ্গের বাগড়াকোট, সিকিম হাইওয়ে নির্মাণ, সেবক রংপো রেলওয়ে লাইন বসানোর জন্য লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মালদা সহ বিভিন্ন জেলায় সমৃদ্ধ আমবাগান ধ্বংস করে একের পর এক প্লট তৈরি করা হচ্ছে। এ ভাবে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনে।
স্পঞ্জ আয়রন, ফেরোঅ্যালয়, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানা, স্টোন ক্র্যাশার ইত্যাদি যে সমস্ত শিল্প ইউনিটের দূষণ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলি নীতি অনুযায়ী পঞ্চায়েত এলাকাতেই হয়ে থাকে। ইউনিটগুলি স্থাপনের প্রাথমিক অনুমোদন পঞ্চায়েতকেই দিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই এই শিল্পগুলি রয়েছে সেগুলির প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক দূষণ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এইসব শিল্পের শ্রমিক, এলাকার সাধারণ মানুষ, বিশেষত বয়স্ক এবং শিশুরা চূড়ান্ত দূষণের শিকার। এলাকার গবাদি পশু, জলাশয়, চাষের খামার, বন্যপ্রাণী এই দূষণের শিকার।
পাহাড় এলাকায় সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবেশ। কোনও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছ কংক্রিটের নির্মাণ মাথা তুলছে। নদী ঝোরা জলস্রোতগুলি বন্ধ করে ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস করে একটার পর একটা নির্মাণ হয়েছে। নদীগুলির গর্ভে একটার পর একটা স্টোন ক্র্যাশার ইউনিট বসছে। কোনও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিস্তীর্ণ এলাকা ধূলিকণায় আচ্ছন্ন করে ফেলা হচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো একটার পর একটা হোটেল তৈরি হচ্ছে। ইকো ট্যুরিজম আর হোম-স্টের নাম করেও বিশাল বিশাল হোটেল তৈরি হচ্ছে। যে বিপুল পরিমাণ আবর্জনা তৈরি হচ্ছে তা সরানোর উদ্যোগ নেই। পাহাড়ের কোণে কোণে জমে উঠছে প্লাস্টিক সহ অন্যান্য আবর্জনার স্তূপ। পাহাড়ে এইসব দূষণের প্রভাব পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন হিসাবে পঞ্চায়েতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এ বিষয়ে চাই সরকারের পক্ষ থেকে সামগ্রিক পরিকল্পনার রোড ম্যাপ। সেটাই অনুপস্থিত। পরিবেশের কী ক্ষতি হল, মানুষের জীবন কীভাবে বিপন্ন হল ভাবার দায় পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচালকদের নেই। আশু লাভটাই তাদের বিচার্য। সরকারের ভূমিকাও তাই। ফলে পরিবেশের বিপন্নতার ধারা প্রবহমান। এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাদী উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় মারাত্মক পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে একদিকে জনগণকে সচেতন করার প্রক্রিয়া অন্যদিকে এই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আর্সেনিক, স্পঞ্জ আয়রন, তাপবিদ্যুতের ছাই দূষণের বিরুদ্ধে নানা স্থানে দলের কর্মীরা আন্দোলন গড়ে তুলছেন। জনসভাগুলিতে সাধারণ সম্পাদক তাঁর বক্তৃতায় পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতাকে তুলে ধরেছেন। এই পরিস্থিতিতে ভোটাররা প্রশ্ন তুলুন, পঞ্চায়েতের পরিবেশ রক্ষায় কী ভূমিকা নেবে তা ক্ষমতায় এলে জনগণকে জানাতে হবে। জনগণকেও ভাবতে হবে পরিবেশ রক্ষার দায় তারও। তার দায় দুভাবে। এক, পরিবেশ দূষণ না করা, দুই, সরকারের ভূমিকা সক্রিয় করার ক্ষেত্রে সমালোচনা, জনপ্রতিবাদ গড়ে তোলা। আওয়াজ তুলুন, মুনাফার জন্য প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস করতে দেব না।