বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামকে অন্যত্র সরানোর কথা ঘোষণা করেছে। এটি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’র জমিতে অবস্থিত। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩১ মার্চের মধ্যেই মিউজিয়াম স্থানান্তর সম্পূর্ণ করতে সংগ্রহশালার ২ লক্ষ ১০ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু ও হস্তশিল্পকে সরানো হবে। অর্থাৎ আগামী বছর সাধারণ নির্বাচনের আগেই এগুলি সরানোর কাজ শেষ করা হবে। হঠাৎ মিউজিয়াম সরানোর এই পরিকল্পনা কেন? কারণ ওই স্থানে ‘যুগে যুগীন ভারত’ নামে অন্য একটি নতুন মিউজিয়াম স্থাপন করা হবে। সরকারের এই ঘোষণা দেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে আশঙ্কা ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
জাতীয় সংগ্রহশালার ইতিহাস
জাতীয় সংগ্রহশালা ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম’ গড়ে ওঠার পেছনে একটি ইতিহাস আছে। ১৯৪৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মরিস গয়ারের নেতৃত্বাধীন কমিটি এই জাতীয় সংগ্রহশালার ব্লু প্রিন্ট প্রথম তৈরি করে। এরপর ১৯৪৭-৪৮ সালের শীতকালে ভারত ও ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় লন্ডনে ভারতীয় শিল্পের বিশেষত নির্বাচিত প্রাচীন হস্তশিল্পের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর সফল অভিজ্ঞতার পর সিদ্ধান্ত হয়, বিভিন্ন মিউজিয়াম থেকে সংগৃহীত এই ধরনের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুসমূহের প্রদর্শনী দিল্লিতেও আয়োজিত হবে। ১৯৪৯ সালে নতুন দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে যে প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয় তা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। এই প্রদর্শনী শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন ও কৌতূহল সৃষ্টি করে। ফলে উদ্যোক্তারা
এই বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুগুলির স্থায়ী সংরক্ষণের জন্য দিল্লিতে একটি জাতীয় সংগ্রহশালা ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর জন্য বিভিন্ন রাজ্যের মিউজিয়ামগুলির এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহকারীদের কাছে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু দান করার অথবা আপাতত দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। আবেদনে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মেলে এবং যাঁদের সংগ্রহে প্রত্নবস্তু ছিল তাঁদের অধিকাংশই ন্যাশনাল মিউজিয়ামের জন্য সেগুলি দান করেন।
১৯৪৯ সালে ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ভবনে এই জাতীয় সংগ্রহশালার সূচনা হয়। জাতীয় সংগ্রহশালা ভবনের অংশটি উদ্বোধন হয় ১৯৬০-এর ১৮ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় পর্বটি সম্পূর্ণ হয় ১৯৮৯ সালে। অত্যন্ত কষ্টসাধ্য উপায়ে বহু অমূল্য ও দুঃষ্প্রাপ্য প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুসমূহকে সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে এই সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে। বর্তমানে এই সংগ্রহশালায় ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর সংখ্যা দুই লক্ষাধিক। এর সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বিগত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল এর দেখভাল করতেন, বর্তমানে এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রকের অধীন।
ইতিহাস বিকৃতি বিপদ বাড়াবে
বিজেপি-আরএসএস যে ভাবে ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করছে, তা মানুষের জানা। জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকরী করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ভারতীয় জ্ঞান প্রণালী’ নামে একটি তথাকথিত নতুন ধারণা নিয়ে আসে। জ্ঞান প্রণালী অনুযায়ী এশিয়া মাইনর থেকে আর্যদের ভারতীয় ভূখণ্ডে পরিযানের ঐতিহাসিক তত্ত্বটি ভুল। ইতিমধ্যেই তারা সিন্ধু সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা নামকরণ করেছেন। সরস্বতী নামে এক কাল্পনিক নদীর অস্তিত্ব খুঁজে বের করবার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রিসার্চ প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। তারা প্রমাণ করতে মরিয়া যে, মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পার সভ্যতা বৈদিক সভ্যতারই অঙ্গ। নচেৎ আর্যদের রামায়ণের নায়ক রামচন্দে্রর কোনও ‘স্পেশাল স্ট্যাটাস’ থাকছে না। সে ক্ষেত্রে মুঘলেরা যেমন বাইরে থেকে এসে এ দেশের বাসিন্দা হয়েছে, আর্যরাও তেমন বলেই প্রমাণিত হয়। যেহেতু হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত শিলালিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তাই আরএসএস এবং সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাঁদের সুবিধামতো, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মনগড়া ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও প্রকৃত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই সমস্ত উদ্ভট তত্ত্বকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁরা জানেন এই সমস্ত প্রাচীন শিলালিপিগুলি ও প্রত্নতাত্ত্বিক হস্তশিল্পগুলির মূল্য কী? তাই তাঁরা আশাঙ্কা করছেন এগুলি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত করতে গিয়ে যদি হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় তা হলে ইতিহাসের পাতা থেকে একটি বড় অধ্যায় চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের ধরন দেখে এই আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এক বছরের কম সময়ে অতি দ্রুততায় ২ লক্ষাধিক অত্যন্ত প্রাচীন এবং মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক শিলালিপি, হস্তশিল্প ও বস্তু স্থানান্তরিত করতে চাইছে। অথচ এগুলি স্থানান্তরণের কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সূক্ষ্ম এবং কিছু কিছু বস্তুকে এমনকি স্পর্শও করা যায় না। যে কারণে ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ১১৫ মিটার লম্বা গ্যালারির দুই হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক হস্তশিল্পকে স্থানান্তরের জন্য দু-বছর সময় নিয়েছিল। তাই এত তাড়াহুড়ো করে এত সংখ্যক দুর্মূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু ও হস্তশিল্পকে সরাতে গেলে তার ভবিষ্যৎ কী হবে, এটা ভেবেই আমাদের দেশের ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা আশঙ্কিত।
প্রাচীন ফলক বা হস্তশিল্পগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছরের প্রাচীন পরিকল্পিত নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। যে সভ্যতা গ্রামীণ ও জঙ্গলকেন্দ্রিক খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও উন্নত। স্থানান্তরনের সময় এই সমস্ত প্রাচীন ফলক এবং হস্তশিল্প ও শিলালিপি যদি নষ্ট হয়, হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় তা হলে সিন্ধু সভ্যতার দু’হাজার বছরব্যাপী প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে যাবে। বোধহয় আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেটাই চাইছেন।
কেন্দ্রীয় সরকার এই আশঙ্কার ব্যাপারে একেবারে নিঃশ্চুপ। এমনকি স্থানান্তরণের এই অন্তর্বর্তী পর্যায়ে মহামূল্যবান প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে, কোথায় রাখা হবে, সেখানে ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকদের দেখার বা গবেষণার সুযোগ হবে কি না, এ ব্যাপারে কোনও কিছু খোলসা করছে না, যা গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বদলে বিজেপি সরকার সংঘ পরিবারের ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আরেকটি নতুন মিউজিয়াম গড়ে তুলতে আগ্রহী, যা নাকি পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বহন করবে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘যুগে যুগীন ভারত’।
বিজেপির বিকৃত ইতিহাসবোধ আজ মানুষের সামনে স্পষ্ট। আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তৈরি ‘যুগে যুগীন ভারত’ মিউজিয়ামে তাঁরা কী রাখবেন তা এখনই পুরোটা বোঝা না গেলেও একটা বিষয় স্পষ্ট–তারা তাদের বিকৃত ইতিহাসকেই নানা মাধ্যমে সেখানে উপস্থিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
তাই অধ্যাপক ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার, আদিত্য ও মৃদুলা মুখার্জী, হরবংশ মুখিয়া, জোয়া হাসান, রামচন্দ্র গুহ প্রমুখ দেশের প্রায় আড়াই হাজার় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ অত্যন্ত উদ্বেগ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক আবেদনে বলেছেন, সরকারের এই পদক্ষেপে আমাদের বহু সাংস্কৃতিক সম্পদ চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সময়ের আহ্বান, দেশের প্রাচীনপ্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলি যা আমাদের মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ তাকে রক্ষা করা এবং দেশের সত্যিকারের ইতিহাসকে বাঁচানোর জন্য জনগণকে এবং শিক্ষাপ্রেমী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।