১২৬তম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী সভায় বিশিষ্টরা
‘সুভাষচন্দ্র বসু নিছক সাদা চামড়ার বদলে কালো চামড়ার শাসকদের বসাতে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেননি।’ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী সভায় বললেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জে চেলমেশ্বর।
তিনি বলেন, ব্রিটিশের শাসনে যে সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি চেয়ে স্বাধীনতার যোদ্ধারা লড়েছিলেন, তার প্রায় সবই থেকে গেছে শুধু নয়, আরও প্রকট হয়েছে। গণতন্ত্রকে নামিয়ে আনা হয়েছে কিছুদিন অন্তর অন্তর নিছক ভোটের কারবারে। সেই ভোটেও মানি পাওয়ার কী ভাবে কাজ করে, বেশিরভাগ জয়ী প্রার্থী কী ভাবে জেতেন তা আজ সকলে জানে। আজ ভারতীয় সমাজ আচ্ছন্ন সংকীর্ণতা, প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতায়। বিচারপতি চেলমেশ্বর আক্ষেপ করেন, নানা রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা অন্য রাজ্যের সাথে নদীর জলের ভাগ নিয়ে, রাজ্যে রাজ্যে সীমানার বিতর্ক নিয়ে ঝগড়া করে নিজের রাজ্যে জনপ্রিয়তা পেতে চান। এমন ভারতের স্বপ্ন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দেখেননি। তিনি সেকুলার স্বাধীন ভারতের জন্য লড়েছিলেন।
এ বছর ২৩ জানুয়ারি ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। গত বছর কোভিডের জন্য তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করা যায়নি। তাই এই বছর বিশেষভাবে দিনটি পালনের ডাক দিয়েছিল সেই উপলক্ষে গঠিত সর্বভারতীয় কমিটি। ওই দিন কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটউট হলের সমস্ত আসন ভরে গিয়েও করিডরে ভিড়ে পা ফেলারও জায়গা ছিল না। হল ছাপিয়ে কয়েক শত মানুষের জমায়েত বাইরের রাস্তায়। কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে এ দিনের কর্মসূচির সূচনা করেন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রতিভা ভারতী মুখার্জী। হলের বাইরে নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। বক্তারা ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলী, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও চিকিৎসক বিনায়ক সেন, কমিটির সহসভাপতি ডাক্তার অশোক সামন্ত, প্রাক্তন সাংসদ ডাক্তার তরুণ মণ্ডল, কমিটির কোষাধ্যক্ষ কমল সাঁই এবং বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা মাল্যদান করেন।
নেতাজি কন্য অনিতা বসু পাফ এবং বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার শ্যাম বেনেগালের পক্ষেও মাল্যদান করা হয়। ১২৬ জন স্বেচ্ছাসেবক নেতাজির নামাঙ্কিত পতাকা হাতে নেতাজির প্রতি গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। উপস্থিত সকলের পক্ষ থেকে শপথ বাক্য পাঠ করেন কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সৌমিত্র ব্যানার্জী। নেতাজির উদ্ধৃতি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ‘সিয়াসত’ উর্দু পত্রিকার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জহিরুদ্দিন আলি খান।
শুরুতে কমিটির সম্পাদক সংক্ষিপ্ত কথায় সভার মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরার পর অধ্যাপক সৌমিত্র ব্যানার্জীর সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিচারপতি চেলমেশ্বর ছাড়াও বক্তব্য রাখেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরউদ্দিন শাহ, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল ও আয়োজক কমিটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি বিমল চ্যাটার্জী, আইআইটি মুম্বইয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও কমিটির অন্যতম সহসভাপতি অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জী। সভায় জার্মানি থেকে অনিতা বসু পাফ অনলাইনে বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও শ্যাম বেনেগাল, প্রাক্তন অ্যাডমিরাল এল রামদাসের ভিডিও বার্তা সভায় দেখানো হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব এবং জেএনইউ-র অধ্যাপক আদিত্য মুখার্জীর বার্তা পড়ে শোনানো হয়। ব্যারিস্টার বিমল চ্যাটার্জী তাঁর বক্তব্যে নেতাজির দেশ গড়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, প্ল্যানিং কমিশন ও সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ও বন্টনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। অধ্যাপক পুনিয়ানি জোর দেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। অধ্যাপক জামিরউদ্দিন শাহ নেতাজি যে ধর্ম থেকে রাজনীতিকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে বলেছিলেন, তা তুলে ধরেন।
কমিটির উদ্যোগে এই দিন সারা দেশেই অসংখ্য কর্মসূচি পালিত হয়। জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও, এআইএমএসএস, কমসোমল ও পথিকৃৎ-এর পক্ষ থেকে সারা দেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নেতাজির ছবি, ব্যাজ, উদ্ধৃতি সংকলন এবং তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারের তাৎপর্য সম্পর্কিত পুস্তিকা প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতি ঘরে ২৩ জানুয়ারি নেতাজির ছবিতে মাল্যদানের আহ্বান জানায় তারা।
২৩ তারিখ সকালে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলার অসংখ্য স্থানে এই সংগঠনগুলির ডাকে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। কলকাতার শিয়ালদহ এলাকায় এনআরএস হাসপাতালের সামনে সংগঠগুলির কর্মসূচিতে নেতাজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন এস ইউ সি আই (সি)-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য। জেলায় জেলায় নানা গণসংগঠন ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ফোরামের পক্ষ থেকে অজস্র আলোচনা সভা, উদ্ধৃতি প্রদর্শনী, প্রভাতফেরির মধ্য দিয়ে নেতাজির প্রতি দেশবাসীরগভীর আবেগই প্রতিফলিত হয়।