ভারতের স্বাধীনতার পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পেলে নিঃসন্দেহে সবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, জনস্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতেন। বিশেষ করে নিরক্ষরতা দূর করতে সচেষ্ট হতেন– ৩১ ডিসেম্বর এক অনলাইন আলোচনা সভায় জার্মানি থেকে অংশ নিয়ে এ কথা বললেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কন্যা অর্থনীতির পূর্বতন অধ্যাপক অনিতা বসু পাফ।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বলিষ্ঠ প্রতিভূ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১-২৩ জানুয়ারি এই মহান বিপ্লবীর সংগ্রামকে স্মরণ করার নানা কর্মসূচি নিয়েছে তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্দেশে গঠিত সর্বভারতীয় কমিটি। ৩১ ডিসেম্বর ছিল সেই কর্মসূচির উদ্বোধনী ওয়েবিনার। ফেসবুক, ইউটিউব সহ নানা মাধ্যমে ভারতের লক্ষাধিক মানুষ এই আলোচনা শোনেন। বিদেশে বসবাসকারী বহু ভারতীয় এই অনলাইন সভায় যোগ দেন। দেশের রাজ্যে রাজ্যে বহু মানুষ হলে বা রাস্তার উপরে একত্রিত হয়ে বড় পর্দায় অনুষ্ঠানটি দেখেন।
নেতাজি-কন্যা অনিতা বসু পাফ বলেন, নেতাজি চেয়েছিলেন ভারত থেকে অশিক্ষা, শ্রমিক-কৃষকের শোষণ, ধর্মে-বর্ণে ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করতে। পুরুষশাসিত সমাজে গরিব মানুষ ও নারীর উপর নিপীড়ন, জাতপাত-বর্ণের বিভেদ এবং শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে নেতাজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণ করে অধ্যাপক বসু পাফ বলেন, সমাজ পরিবর্তনে ছাত্র ও যুব সমাজকে নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন নেতাজি। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীতে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসকে নেতাজি কোনও দিন ধর্মনিরপেক্ষ নীতির উপরে স্থান দেননি।
ওয়েবিনারের অন্যতম বক্তা কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ সৌমিত্র ব্যানার্জী বলেন, নেতাজি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও শক্তিগুলিকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন লড়াই করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুস্পষ্ট দুটি ধারার কথা উল্লেখ করে আপসহীন ধারার বলিষ্ঠ প্রতীক হিসাবে নেতাজির অনন্য ভূমিকার কথা তুলে ধরেন ডঃ ব্যানার্জী। তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে যারা সমস্ত দিক থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চরম বিরোধিতা করেছে, তাদের অনুগামীরাই আজ নেতাজির নাম ব্যবহার করে নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। ডঃ ব্যানার্জী বলেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি থেকে ধর্ম বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখার কথা বলেছেন নেতাজি। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে ও ব্যক্তি-জীবনে তিনি এই ধর্মনিরপেক্ষ নীতির চর্চা করে গেছেন। ডঃ ব্যানার্জী দেখান, সংগ্রামের পথে নেতাজি হিন্দু ধর্মভিত্তিক পুরনো চিন্তার থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছিলেন। জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে তিনি উত্তরণের পথে এগিয়েছেন ক্রমাগত। নেতাজির মতো বড় চরিত্রের মানুষেরও শ্রদ্ধা, ভালবাসা আকর্ষণ করার মতো চরিত্র হিসাবে তাঁর স্ত্রী এমিলি শেঙ্কলের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ডঃ ব্যানার্জী। সামাজিক আন্দোলনে দেশের ছাত্র-যুবদের এগিয়ে আসার জন্য নেতাজির আহ্বানকে তুলে ধরেন ডঃ ব্যানার্জী। তিনি বলেন, নেতাজি স্মরণের প্রকৃত তাৎপর্য রয়েছে তাঁর চিন্তা এবং জীবন-সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়়ে ভারতের বর্তমান সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করার মধ্যেই। দেশের সর্বত্র যে সব অন্যায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, উপযুক্ত আদর্শ ও উন্নত নৈতিকতা, উন্নত রুচি-সংস্কৃতির ভিত্তিতে এ সবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হল নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও নিজে বড় মানুষ হয়ে ওঠার যথার্থ পথ। আজকের দিনে মানুষের শোষণমুক্তির জন্য সঠিক আদর্শ খোঁজা ও তার চর্চার উপর জোর দেন তিনি। ডঃ ব্যানার্জী বলেন, নেতাজির এই মহান সংগ্রামের উৎস ছিল দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা। তিনি বর্তমান ছাত্র-যুবকদের কাছে নেতাজির জীবনের এই শিক্ষাকে স্মরণ করিয়ে দেন।
সভা পরিচালনা করেন আয়োজক কমিটির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি বিশ্বাবসু দাস।