নীতিভ্রষ্ট রাজনীতির কুৎসিত প্রদর্শনী


কে বড় রাম ভক্ত! হনুমানকে বুক চিরে প্রমাণ করতে হয়েছিল তার ভক্তির জোর৷ এই ঘোর কলি যুগে বিজেপি–তৃণমূলে লেগেছে টক্কর ভক্তির ভাগ নিয়ে! বিজেপি নেতারা ভক্তির প্রমাণ দিতে রক্তও ঝরিয়েছেন, তবে হনুমানের মতো নন তাঁরা৷ তাই নিজেদের বুক চিরে ভক্তি দেখাতে যাননি, তার বদলে পুরুলিয়ার বেলডি গ্রামের নিরীহ গ্রামবাসী সাজাহান সেখের প্রাণ নিয়ে, আরও অনেকের রক্ত ঝরিয়ে মুর্শিদাবাদের কান্দিতে তাণ্ডব করে ভক্ত সেজেছেন তাঁরা৷

বিজেপির এই নীতি–ভ্রষ্ট রাজনীতির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য তৃণমূল যেভাবে একই কায়দায় প্রবল প্রতিযোগিতায় নেমেছে তা রাজ্যের মানুষকে আরও আশঙ্কিত করে তুলেছে৷ দুই দলের এই রেষারেষিতে বিজেপির নেতারা যত লম্ফ–ঝম্প করেছেন, গদা ঘুরিয়েছেন, তত তৃণমূল নেতারাও একই কায়দায় লাফ–ঝাঁপ বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ তাঁরাও হুঙ্কার ছেড়ে বলেছেন, ‘রাম কি বিজেপির একার’ বড় হিন্দু সাজার এই প্রতিযোগিতায় সারা বাংলা জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক আতঙ্কের পরিবেশ৷ অথচ বাংলার দীর্ঘকালের ঐতিহ্য এই সময় অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজোর মতো কিছু উৎসব পালন৷ তাতে কারও আতঙ্ক সৃষ্টির কথা কখনও শোনা যায়নি৷ রামনবমী এমনিতেই কোনও দিন বাংলার উৎসব ছিল না৷ তার উপর রামের নামে এই বিকট উল্লাস, অস্ত্রের আস্ফালন, এমনকী শিশু–কিশোরদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ আদৌ কোনও ধর্মাচরণ বা ভক্তির প্রকাশ হতে পারে না৷

তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া নেতা মুকুল রায় এবিষয়ে বলেছেন, ‘ভারতীয় সংস্কৃতি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হল’৷ তার মানে? বিজেপি কী বলতে চায়?  কে বলল এই বীভৎসতা ভারতীয় সংস্কৃতি? কোন রামায়ণে তাঁরা এসব জিনিস পেয়েছেন? বাল্মিকী থেকে তুলসীদাস হয়ে বাংলার কৃত্তিবাস ওঝা কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা তিনশোর বেশি রামায়ণের কোন সংস্করণে এই তরোয়ালধারী, ফেট্টিধারী নরহত্যাকারী রামের কথা লেখা আছে?

রামনবমী নাকি রামের জন্মদিন যদিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘নারদ কহিলা হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়’৷ কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’’(ভাষা ও ছন্দ)৷ অর্থাৎ কবির কল্পনাতেই জন্ম রামের, বলছেন রবীন্দ্রনাথ৷ কিন্তু রামনবমী পালনের নামে যে রামকে বিজেপি উপস্থিত করল তার জন্ম একমাত্র ক্ষমতার গদি লোভী ধুরন্ধর নেতাদের উর্বর মস্তিস্কেই এই রাম ভক্তির জিগির তুলেই তারা পাঁচশো বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙেছে, বারবার দাঙ্গা লাগিয়েছে, হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে৷ এটা কি ভারতীয় সংস্কৃতি?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তৎকালীন একদল উগ্র ধর্মধ্বজীদের দেখে লিখেছিলেন, ‘‘তাঁহারা শাস্ত্রেরও উমেদার নহেন, ধর্মেরও উমেদার নহেন, তাঁহারা উমেদার পয়সার’’ (ব্রজবিলাস)৷ বিজেপি সম্বন্ধে বলা যায় তারা রামের বা ধর্মের কারও উমেদারই নন– তারা উমেদার সরকারি গদির, উমেদার ভোটের আর তার জন্য তারা বড় উমেদার একচেটিয়া কর্পোরেট মালিকদের৷ তাদের থলি থেকেই ভরে বিজেপির কোটি কোটি টাকার ভোট তহবিল৷ তৃণমূলও একই প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ তৃণমূলের নেতারা, এমনকী মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত যেভাবে রামনবমী নিয়ে হইচই তুলে দিয়েছেন তাতে সুবিধা হয়েছে বিজেপিরই৷ ২০১৪ তে কর্পোরেট মালিকরা বিজেপিকে প্রচার দিয়ে দিয়ে একেবারে মানুষের কল্পনার মগডালে তুলে দিয়েছিল৷ নরেন্দ্র মোদিকে বানিয়ে দিয়েছিল প্রায় এক অবতার৷ বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় প্রায় চার বছর পার করে দিতে না দিতেই বাস্তবের অভিঘাতে দেশের মানুষের মন থেকে সেই মোহ–জাল অন্তর্হিত হয়ে গেছে৷ সামনে লোকসভার ভোট৷ কর্পোরেট মালিকদের সেবা করতে গিয়ে বিজেপি যে শোষণের স্টিম রোলার চালিয়েছে তাতে দেশের মানুষের ধিক্কার আর অভিশাপ কুড়োচ্ছে তারা৷ দেশের বেকার যুবক–যুবতীদের চাকরির প্রতিশ্রুতির কী হবে? পকোড়া ভাজাই কি বেকারদের ভবিষ্যত? কৃষক আত্মহত্যা ভয়াবহ ভাবে বাড়ছে কেন? কেন সারা দেশে কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছে না, অথচ চড়া দামে তা খুচরো বাজারে বিকোচ্ছে? কালো টাকা উদ্ধারের নাটকের যবনিকা পাত কোন ক্লাইম্যাক্সে হবে? নোট বাতিল করে দেড়শো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে কতজন কালো টাকার মালিককে ধরল সরকার?  বিজেপির এমপি বিজয় মালিয়া থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যাঙ্ক লুঠেরা পুঁজিপতি নীরব মোদি–মেহুল চোক্সিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কী হবে? ১০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ব্যাঙ্কের ঋণ মেরে দেওয়া বড় বড় মালিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় না করে সরকার তার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপাচ্ছে কেন? দেশের মানুষের মধ্যে থেকে ওঠা এই সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন এড়িয়ে আবার ভোট চাইবার জন্য বিজেপির একমাত্র সম্বল রাম ভক্তির ভেক৷

তৃণমূলও বিজেপির থেকে বড় ‘হিন্দু’ সাজতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ বিজেপির মতোই একই ভোটব্যাঙ্কের খেলায় তারা কখনও মন্দিরে ছুটছে, ব্রাহ্মণ সম্মেলন, পুরোহিত সম্মেলন করছে, হনুমান জয়ন্তীর উৎসবে যুবকদের মাতাচ্ছে৷ আবার ইমাম ভাতা চালু করছে, নেতা নেত্রীরা মসজিদ–গির্জাতেও দৌড়চ্ছেন৷ তৃণমূল নেতারা হয় বুঝছেন না, অথবা বুঝতে চাইছেন না ধর্মের চ্যাম্পিয়ান সেজে কখনও ধর্মব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করা যায় না৷

শিশু কিশোরদের হাতে আরএসএস–বিজেপি অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের যে সর্বনাশা বিদ্বেষের রাজনীতির দিকে তারা ঠেলে দিচ্ছে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়৷ এই আরএসএস–বিজেপির পরিচালিত ‘হিন্দু স্বাভিমান’ নামে একটি সংগঠন উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে দুই বছর ধরে চালাচ্ছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির৷ যেখানে শিশু–কিশোরদের শেখানো হয়– নির্মম হাতে শত্রু নিধন করতে৷ কারা শত্রু? শেখানো হয়– মুসলমানরাই শত্রু৷ এই সব শিবিরে পিস্তল থেকে তরোয়াল–ভোজালি–ছুরি সবকিছুর শিক্ষা চলছে৷ (টাইমস অফ ইন্ডিয়া–২০.০১.১৬)

এই পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের শিবির খোলার চেষ্টা করছে তারা, যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশের শিবিরের কর্তারা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আইএস’ অর্থাৎ ‘ইসলামিক স্টেটের’ মতো তাঁরা ‘এইচএস’ অর্থাৎ ‘হিন্দু স্টেট’ নামে একই ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে চান৷ সিরিয়া, ইরাকে আইসিস যে শিবির চালায় তাই হয়েছে আরএসএস–বিজেপির কাছে অনুসরণযোগ্য মডেল তৃণমূল যদি ভেবে থাকে বিজেপিকে আটকাতে পশ্চিমবঙ্গে একই মডেলে রাম ভক্তির জোয়ার তুলেই তারা ভোট বৈতরণী পার হয়ে যাবে, তাতে যে সাম্প্রদায়িকতার উর্বর জমি তৈরি হবে তা বড় সাংঘাতিক৷ একে হাতিয়ার করে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সর্বনাশ হবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের৷

স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে৷ ১৯৪০ সালে ঝাড়গ্রামের ভাষণে তিনি বলছেন, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা হিন্দু মহাসভার নামে রাজনীতিতে প্রবেশ করে তাকে কলুষিত করেছেন৷ … সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছেন৷ ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে৷ ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে৷ হিন্দু মাত্রেরই তার নিন্দা করা কর্তব্য৷ … এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন, তাদের কথা কেউ শুনবেন না৷ আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাপ্রেমী নরনারী একপ্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক৷’’– (আনন্দবাজার পত্রিকা – ১৪.৫.১৯৪০)৷ সুভাষচন্দ্রের এই কথাকে সেদিনের এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ক্ষমতাসীন নেতারা মর্যাদা দেননি৷ সিপিএম তাদের ৩৪ বছরের রাজত্বে বামপন্থার চর্চা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল৷ নীতি–নৈতিকতার ধার ধারেনি৷ তার যতটুকু অবশিষ্ট ছিল তৃণমূল এসে সেটুকুকেও নির্মূল করে দিল৷ তার ফলেই ধর্মের নামে ভণ্ড রাজনীতির কারবারি বিজেপি আজ বাংলায় এই ভ্রষ্টাচার চালাতে পারছে৷ বাংলার সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পর্যন্ত কলার ধরে টেনে বার করার কথা বলেও তাদের রাজ্য সভাপতি পার পেয়ে যাচ্ছেন৷

এই ভণ্ড রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ রুখে দাঁড়াতে হবে৷ কিন্তু তা কোনও নির্বাচনী জোট, পাল্টা ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে হবে না৷ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে নীতি–আদর্শ ভিত্তিক সঠিক রাজনীতি নিয়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেই এর মোকাবিলা সম্ভব৷