১৬ ডিসেম্বর এলেই মনে পড়ে সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা। দশ বছর আগে ২০১২-এর এই দিনটিতে দিল্লিতে চলন্ত বাসে এক প্যারামেডিকেল ছাত্রীর ওপর পৈশাচিক অত্যাচারের ঘটনায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। তেরো দিন মর্মান্তিক যন্ত্রণা সহ্য করার পর মৃত্যু হয় মেয়েটির। ততদিনে দেশ তাকে চিনেছে ‘নির্ভয়া’ নামে। ক্ষেপে উঠেছিল গোটা দেশের মানুষ। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে অবরুদ্ধ হয়েছিল দিল্লির রাজপথ। প্রশাসন লাঠি-গ্যাস-জলকামান চালিয়েও সেই বিক্ষোভের আগুন নেভাতে পারেনি। দেশ জুড়ে প্রবল গণবিক্ষোভ এবং আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত দোষীদের চরম শাস্তি সহ নারী সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সরকার।
আট বছর ধরে নানা দীর্ঘসূত্রতা, টালবাহানার পর অবশেষে ২০২০-র মার্চে নির্ভয়ার অপরাধীদের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছে। কিন্তু ঘটনার এত বছর পরেও আজ, এই ২০২২-এর ভারতবর্ষে কেমন আছেন দেশের মেয়েরা? সামান্যতম নিরাপত্তা তাঁরা পেয়েছেন কি? এতটুকুও কি বদলেছে দেশের, সমাজের পরিস্থিতি?
‘বেটি বাঁচাও-বেটি পড়াও’ স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান এবং মহিলাদের প্রতিদিনের আশঙ্কা-আতঙ্ক-চোখের জল বুঝিয়ে দিচ্ছে, দেশের বেটিরা সত্যিই বাঁচতে পারছেন কিনা, প্রধানমন্ত্রী সহ কেন্দ্র বা বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের তা ভাবার সময় নেই। জনগণের ক্ষোভ স্তিমিত করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নারী সুরক্ষার ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘নির্ভয়া ফান্ড’ তৈরি করেছিল। সেই ফান্ডের টাকা বয়ে গেছে অন্য খাতে, এমনকী মন্ত্রীদের গাড়ি কেনার কাজেও। নারী সুরক্ষার ব্যবস্থা না হোক, তা নিয়ে মিডিয়ার প্রচারে খরচ হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা।
সদ্য সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে শ্রদ্ধা ওয়ালকর হত্যার ঘটনা। বাবা-মার অমতে যে প্রেমিকের হাত ধরে শ্রদ্ধা ঘর ছেড়েছিলেন, সেই মানুষটাই তাকে নৃশংস ভাবে খুন করে ভয়াবহ পৈশাচিকতায় ঠাণ্ডা মাথায় দেহ লোপাটের চেষ্টা করল। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ঝাড়খণ্ডের অঙ্কিতাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারল এক যুবক। আবার বহরমপুরে এক ছাত্রীকে ভরসন্ধ্যায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হল। এছাড়া বধূ-নির্যাতন, পণ না পেয়ে হত্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, নারীপাচার তো প্রতিদিনের ঘটনা। এর যেন বিরাম নেই, শেষ নেই। এ সমাজে যেন মেয়েদের় মুক্তি নেই।প্রশ্ন জাগে, সমাজটা কেন কীভাবে এত বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে? নারীজঠর থেকে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ কী করে আর একজন নারীকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করতে পারছে? এই সমাজ মানুষকে কেন অমানুষে পরিণত করছে?
যদিও এ সব ঘটনা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের হয়েছে ৪ লক্ষ ২৮ হাজার ২৭৮টি, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। এর বাইরেও অসংখ্য নির্যাতনের ঘটনা নানা কারণে নথিভুক্ত হয় না। গার্হস্থ্য হিংসায় যদি বাড়ির লোক, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে যদি প্রভাবশালী কেউ যুক্ত থাকেন, অনেক সময়ই অভিযোগ জানানোর সাহস হয় না নির্যাতিতার। যারা সাহস করে এগিয়েও আসেন, সুবিচারের জন্য শুরু হয় তাদের অনন্ত অপেক্ষা। আদালতে জমতে থাকে অভিযোগের পাহাড়। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের সুবিধে করে দেয়। নেতা-মন্ত্রী-আমলা কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় থাকা দুষ্কৃতীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ রাজ্যে হাঁসখালির ঘটনায় যেমন দেখা গেল, রাজ্যের শাসক দলের নেতার ছেলে জন্মদিনে নাবালিকা বান্ধবীকে বাড়িতে ডেকে গণধর্ষণ করল। তারপর বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে মেয়েটির পরিবারকে এমন ভয় দেখানো হল যে তারা থানায় অভিযোগ জানানো দূরের কথা, সময় মতো মেয়েটিকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হল মেয়েটির। উত্তরপ্রদেশের হাথরস বা জম্মুর কাঠুয়ায় শাসক দল বিজেপির নেতারা সরাসরি ধর্ষকদের পাশে দাঁড়ালেন। অতি সম্প্রতি গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের, তার শিশুকন্যার নৃশংস খুনিদের সাজার মেয়াদ কমিয়ে মুক্তি দেওয়া হল শুধু নয়, মুক্তি পাওয়ার পর তাদের মালা পরিয়ে মিষ্টি খাইয়ে বরণ করা হল বিজেপি অফিসে। দেশের উচ্চতম বিচারালয় পর্যন্ত এই জঘন্য অপরাধীদের শাস্তি মকুবের বিরুদ্ধে ওঠা পিটিশন খারিজ করে দিল। কোনও সভ্য দেশে এ জিনিস ভাবা যায়!
এসব ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের নেতারা নারীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন শুধু বত্তৃতার মঞ্চে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ভোট টানা। বাস্তবে লাগাতার বেড়ে চলা নারী-নির্যাতন নিয়ে তাঁরা ছিটেফোঁটাও উদ্বিগ্ন নন। উল্টে বহু ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের অপদার্থতা ঢাকতে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য তাঁরা মহিলাদেরই দায়ী করেন। নিদান দেন, নারীরা নির্যাতিত হয় কারণ তারা লক্ষণরেখা অতিক্রম করে বাড়ির বাইরে যায়। পুলিশ এবং প্রশাসনের আমলাদের ভূমিকাও একই। কোনও প্রশাসক নারী-সুরক্ষায় আন্তরিক হলে প্রথমেই তিনি এই সমস্ত ধর্ষক-খুনি-নির্যাতনকারীদের কঠোর সাজা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতেন, পথেঘাটে-কর্মস্থলে নারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেন। লিঙ্গসাম্যের প্রতিষ্ঠা, সমাজ মানসিকতায় গেড়ে বসে থাকা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আঘাত করা দূরের কথা, এই প্রাথমিক কাজটুকুও তো কেউ করছেন না!
নারীর উপর এই উৎপীড়নের মানসিকতার পিছনে আসলে রয়েছে তাদের পূর্ণ মানুষ না ভেবে শুধুই বংশবৃদ্ধির, শুধুই যৌনলালসা চরিতার্থ করার যন্ত্র হিসাবে দেখা। সমাজে গেড়ে বসে থাকা এই মানসিকতার বীজ অনেক গভীরে। পুঁজিবাদের শুরুর দিনগুলোয় অর্থনীতিতে সামন্ততন্ত্রকে ভেঙে সম্পত্তির ওপর ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির সাথে সাথেই সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল। শিক্ষায় সম্পত্তিতে কর্মক্ষেত্রে নারীর সমমর্যাদা সমানাধিকারের দাবিও তার সাথে যুক্ত ছিল। দেশে দেশে শ্রমজীবী নারীসমাজ সেদিন নানা অধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বহু বরেণ্য মনীষী। কিন্তু পুঁজিবাদ যেহেতু একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা এবং তার একমাত্র লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা, তাই যত দিন গেছে ক্রমে প্রগতিশীলতা হারিয়ে, শুরুর দিনের গণতন্ত্রের স্লোগান ছেড়ে সে স্বৈরতন্ত্রকে আশ্রয় করেছে। আজকের প্রতিক্রিয়াশীল মুমূর্ষু পুঁজিবাদ তাই মুখে ব্যক্তিস্বাধীনতার বুলি আওড়াতে আওড়াতেই ব্যক্তির যথার্থ স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যা করছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দূরে থাক, সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার স্বাধীনতাটুকুও এ সমাজে নেই। নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। নিরানব্বই শতাংশ মানুষের শ্রম লুঠ করে এক শতাংশ মালিকের মুনাফার পাহাড় বানানোর এই ব্যবস্থা কখনওই নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা, অধিকার দিতে পারে না। তাই চারপাশে তাকালে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, বড় বড় দলগুলো মুখে যতই নারীমুক্তি নারীপ্রগতির কথা বলুক, বাস্তবে তাদের আচরণে কাজেকর্মে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রতিফলন। একদিকে সমাজে নারীসুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গাফিলতি, অবহেলা, অন্যদিকে বাজারি বিজ্ঞাপনে নারীদেহের অবাধ পণ্যায়ন।
নারীকে ভোগের বস্তু, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবা, নারীর উপর কর্তৃত্ব করার যে মানসিকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে, তা দূর করতে গেলে শুধু পুরুষতন্ত্র ঘা খাবে না, টান পড়বে এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গোড়াতেও। তাই নিজেকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই পুঁজিবাদ চায়, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রসার ঘটুক। তাই এই সমাজে পুরুষকেও যেমন নারীকে মানুষ ভাবার বদলে ‘মেয়েমানুষ’ ভাবতে শেখানো হয়, নারীকেও পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বিকশিত হতে দেওয়া হয় না। সমাজের একটা বড় অংশের মেয়েকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পূর্ণ মানুষ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার বদলে হীনমন্যতা, নির্ভরশীলতা, পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে সাজপোশাকে কাজেকর্মে তাদের খুশি করার মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠতে বাধ্য করা হয়। একদিনে এ পরিস্থিতি পাল্টাবে না। শুধুমাত্র কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সঠিক রাজনৈতিক দর্শনকে হাতিয়ার করে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা এবং উন্নত সংস্কৃতির আধারে তার পরিপূরক সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলাই দেশের মাটিতে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাক্সর্বাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘মানব সমাজে যতরকম শোষণ-অত্যাচার বলবৎ আছে, সেই সব রকম শোষণ-অত্যাচারের অবসান ঘটাতে হবে। এটাই হল আমাদের লক্ষ্য। নারীর উপর যে অন্যায়-জুলুম চলছে তারও অবসান ঘটাতে হবে। আর এই কাজ আপনারা তখনই করতে পারবেন যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও উৎপাদন যন্ত্রকে ব্যক্তি মালিকানা থেকে মুক্ত করতে পারবেন, তার আগে নয়। অর্থাৎ ব্যক্তি মালিকানার অবসানের পথেই যথাযথ নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা অর্জিত হবে। এই জন্য নারীদেরও বুঝতে হবে যে, যদি তারা সত্যি স্বাধীনতা চান, সমান মর্যাদা চান, তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য যে লড়াই সেই লড়াইতেও তাদের একইভাবে সামিল হতে হবে।’ আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা যারা নারী জীবনের যন্ত্রণা-লাঞ্ছনার অবসান চাইছি, আমরা যারা যথার্থ অর্থে নারীমুক্তি চাইছি, তাদের এগোতে হবে এই পথেই।