বেতন বঞ্চনা অবসানের দাবিতে অবশেষে নার্সেস ইউনিটির আন্দোলন জয়যুক্ত হল। সিপিএম সরকারের সময় থেকে এই আন্দোলন শুরু। কিন্তু ওই সরকার দাবি মানেনি। তৃণমূল সরকারও দীর্ঘকাল উপেক্ষা করেছে। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে ২৬ জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ১২ দিনের মাথায় দাবি ছিনিয়ে নিল। নার্সিং আন্দোলনের ইতিহাসে এই জয় ঐতিহাসিক।
৬ আগস্ট কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল পরিণত হয়েছে আন্দোলনের কেন্দ্রে। যতদূর চোখ যায় শুধু মাথা আর মাথা। সাদা অ্যাপ্রন পরে হাজার হাজার নার্সিং অফিসার স্লোগান তুলছেন, বক্তব্য রাখছেন। উপেক্ষা আর অবজ্ঞা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে তাঁদের। তাঁরা এসেছেন তাঁদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রতিকারের দাবিতে। কিন্তু কর্তব্যে অবহেলা করে নয়, রোগী পরিচর্যা সহ যাবতীয় কাজ সেরেই তাঁরা নানা জেলা থেকে এসেছেন সংগ্রামী সংগঠন নার্সেস ইউনিটির নেতৃত্বে এই আন্দোলনে যোগ দিতে।
কেউ নাইট, কেউ মর্নিং ডিউটি করে এই আন্দোলনে এসেছেন, কেউ আবার ফিরে গিয়ে ইভনিং বা নাইট ডিউটিতে যোগ দিয়েছেন। কোভিড পরিস্থিতিতে দায়িত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে রাজ্যের বেশিরভাগ নার্সিং কর্মচারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী সহ সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে। পাশে দাঁড়িয়েছে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম, এ আই এম এস এস, এ আই ইউ টি ইউ সি, পিএমপিএআই সহ নানা সংগঠন।
সরকারি সকল স্তরের নার্সিং অফিসাররা কংগ্রেস সরকারের সময় থেকেই তাঁদের ন্যায্য বেতন কাঠামোতে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। নার্সিং অফিসারদের দাবি সত্তে্বও বেতন কমিশন বা রাজ্য সরকার চরম বেতন বঞ্চনা নিরসন করে যুক্তিভিত্তিক, ন্যায়সঙ্গত বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেননি। (জিএনএম) ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত নার্সিং অফিসারদের ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত হিসাবে বেতন কাঠামো এ পর্যন্ত নির্ধারণ করাই হয়নি। বেতন কমিশন যেমন বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিভিত্তিক, মর্যাদাকর বেতন কাঠামোর সুপারিশ করেনি, তেমনই একের পর এক নির্বাচিত রাজ্য সরকারও তাঁদের ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হিসাবে গণ্যই করেননি।
এ ছাড়া কমিউনিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত এএনএম (আর) থেকে পিএইচএন, ডিপিএইচএন, অন্যদিকে নার্সিং-স্কুল, কলেজের টিচার, ক্লিনিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর, লেকচারার, প্রফেসর, হাসপাতালের সিস্টার ইনচার্জ, ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট, নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট পর্যন্ত কে হননি এই চূড়ান্ত বঞ্চনার শিকার। শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ কাল, অভিজ্ঞতা, কাজের দায়িত্বের উপর ভিত্তি করে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করার নীতি নার্সিং কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়নি। বেতন কমিশন ও রাজ্য সরকার এইভাবে বঞ্চনা করে নার্সিং কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদাকে যেমন ক্ষুন্ন করেছে, তেমনই সমগ্র নার্সিং পেশার গুরুত্বকে লঘু করছে।
কোভিড পরিস্থিতিতে জীবন বাজি রেখে এঁরা যোদ্ধার ভূমিকা পালন করলেও এদের প্রতি সরকারি বঞ্চনা এতটুকু কমেনি। ফলে ক্ষোভের বারুদ জমছিলই।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে টানা আন্দোলন চলছিল নার্সিং কর্মচারীদের। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্যকর্তা, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়। স্বাস্থ্য দপ্তর নানা টালবাহানা করতে থাকে। অবশেষে এ বছরের জুলাই মাস ধরে তীব্র আন্দোলন করতে বাধ্য হন নার্সিং কর্মচারীরা। বেতন বঞ্চনা নিরসন, সকল প্রশিক্ষিত নার্সকে স্থায়ী পদে নিয়োগ, নার্সিং কর্মচারীদের উপর প্রশাসনিক অত্যাচার বন্ধের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া সত্ত্বেও কোনও কাজ না হওয়ায় ২৬ জুলাই থেকে নার্সিং কর্মচারীরা অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেন এসএসকেএমে। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে ১০ হাজারেরও বেশি নার্স এতে যোগ দেন। টানা ১২ দিন অবস্থানের পর সরকারের টনক নড়ে। ৬ আগস্ট নার্সেস ইউনিটির সম্পাদিকা ভাস্বতী মুখার্জী ও সভানেত্রী পার্বতী পালকে ডেকে পাঠান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রী ৩-৪ মাসের মধ্যে দাবি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন। এই ঐতিহাসিক জয় প্রমাণ করল ভোটে নয়, এমএলএ-এপি-মন্ত্রীর জোরে নয়, সঠিক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একমাত্র দাবি আদায় সম্ভব।