২৮ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে গুজরাট, ছত্তিশগড, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাব– এই পাঁচটি রাজ্যের ১৩টি জেলায় প্রতিবেশী তিনটি দেশ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ) থেকে আগত শরণার্থী যাঁরা দীর্ঘদিন ভারতে বসবাস করছেন তাঁদের মধ্যে হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, পারসিক, বৌদ্ধ এবং শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের এই তালিকায় রাখা হয়নি। এর জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘকাল অপেক্ষা করে থাকা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়াতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সুকৌশলে নাগরিকত্বের সাথে ধর্মীয় বিষয়টিকে জুড়ে দিতে স্বাভাবিকভাবেই, দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে।
নাগরিকত্বের সাথে ধর্মের প্রশ্নটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে সরকার জুড়ে দেওয়ায় মানুষের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, এর মধ্য দিয়ে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার তাদের ‘ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বে’র পরিকল্পনা, যা তারা ২০১৯ সালের সিএএ-এর মধ্য দিয়ে চালু করার চেষ্টা করেছে তারই প্রথম পদক্ষেপ শুরু হল। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৬ ধারা এবং ২০০৯ সালে জারি করা এই আইনের রুলের ভিত্তিতেই বিশেষ ক্ষমতা বলে তারা এই নির্দেশ দিয়েছে। সরকারেরর দাবি এই নির্দেশের সঙ্গে সিএএ চালু করার কোনও সম্পর্ক নেই। পুরনো নাগরিকত্ব আইন অনুসারেই এই নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এই নির্দেশেও আপাতদৃষ্টিতে তাই লেখা আছে। সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রথম থেকে বলে আসছেন, কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে প্রাপ্ত বিশেষ ক্ষমতাবলেই দীর্ঘকাল ধরে ভারতের মাটিতে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে (ন্যাচারালাইজেশনের ভিত্তিতে) নাগরিকত্ব দিতে পারে। তার জন্য সিএএ-তে যেভাবে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের কথা বলা হয়েছে তা অপ্রয়োজনীয় এবং বিভেদমূলক। এই নোটিশেও দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দীর্ঘকাল বসবাসকারী মানুষগুলির নাগরিকত্বের সমাধান প্রচলিত আইনেই করতে পারে। সরকারের কাজই প্রমাণ করছে সিএএ নাগরিকত্বের নয় ধর্মীয় বিভাজনেরই কৌশল।
আইনি মারপ্যাঁচের কৌশল
একথা ঠিক যে, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৬নং ধারায় কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় কোনও নির্দেশ জারির বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে। এটুকু দেখিয়েই তারা বেশ কয়েকটি জেলায় বসবাসকারী তিনটি দেশের নাগরিকদের বিশেষ বিশেষ ধর্ম উল্লেখ করে (অবশ্যই মুসলিম ধর্মাবলম্বিদের বাদ দিয়ে) নাগরিকত্বের আবেদন করতে বললেন। ১৯৫৫ থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত নাগরিকত্ব আইনের ছ’টি সংশোধন হয়েছে। কিন্তু ২০১৯-এর আগে নাগরিকত্ব আইনে কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের নাগরিকত্ব প্রমাণের কথা বলা নেই। আইনের বিরাট বোদ্ধা না হলেও এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কোনও নিয়ম বা আইন প্রয়োগে সরকারের ‘বিশেষ ক্ষমতা’ মানে সেই নিয়ম পরিবর্তন করার অধিকার বোঝায় না। আসলে যেহেতু অতীতে সিএএ চালু করতে গিয়ে এ দেশের ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে আপামর সাধারণ মানুষের বিপুল প্রতিবাদ ও বাধার সম্মুখীন তারা হয়েছিল, তাই তা থেকে বাঁচতে অত্যন্ত সুকৌশলে আইনি মারপ্যাঁচের আড়ালে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তারা কার্যত ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের, বিজেপির পূর্বঘোষিত নীতিকেই স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামুলকভাবে চালু করে জনগণের প্রতিক্রিয়া মাপতে চাইছেন। যদি তাঁরা এ কাজে সফল হন, তাহলে ধীরে ধীরে গোটা দেশেই এই প্রক্রিয়া তাঁরা চালু করবেন। এক কথায়, এই নির্দেশ বিভ্রান্তিকর, গভীর ষড়যন্ত্রমূলক এবং এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও সাংবিধানিক অধিকার বিরোধী। সাথে সাথে এ দেশের আপামর সাধারণ মানুষকে আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, এই নীতির ফলে শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বঞ্চিত হবেন এ কথা ভাবা ঠিক নয়। আসলে অমুসলিম জনগোষ্ঠীদেরও তাঁরা বাধ্য করবেন বিজেপির পেছনে দাঁড়াতে বা বিজেপিকে সমর্থন করতে, না হলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। আর সাধারণ মানুষও নাগরিকত্ব হারানোর ভয় থেকে বাধ্য হবেন বিজেপিকে ভোট দিতে বা সমর্থন করতে। বাস্তবে নাগরিকত্ব প্রদানের যে জটিল প্রক্রিয়া, তাতে প্রত্যেককেই নাগরিকত্বের আবেদন করার সাথে সাথে বৈধ পাসপোর্ট ভিসা সহ অন্যান্য প্রমাণপত্র পেশ করতে হবে। অভাবের তাড়নায় বা অন্যান্য কারণে উদ্বাস্তু হয়ে আসা সাধারণ গরিব মানুষদের কারও কাছেই এ ধরনের প্রমাণপত্র নেই। ফলে বাস্তবে তাঁরা কেউই নাগরিকত্ব পাবেন না। এনআরসি তালিকায় অনুপ্রবেশকারী হিসেবে নথিভুক্ত হয়ে সারা জীবন ডিটেনশন ক্যাম্পে বা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সমস্ত বৈধ অধিকার এবং সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে অবর্ণনীয় জীবন কাটাবেন। আসামে ইতিমধ্যেই ১২ লক্ষেরও বেশি অমুসলিম নাগরিকদের এই অবস্থাই হয়েছে।
এই সময়ে কেন এই নির্দেশ
সমস্ত দেশ জুড়ে করোনা অতিমারি দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ প্রকোপ এখনো অব্যাহত। সরকারি অপদার্থতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। এই অবস্থায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা তো দূরে থাক, কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও শোষণের নজিরবিহীন স্টিম-রোলার চালাচ্ছে। তারা দেশি-বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিদের স্বার্থে শিল্প-কৃষি-রেল-ব্যাঙ্ক-শিক্ষাসহ পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোর সার্বিক বেসরকারিকরণের নীতি গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন করছে, আবার এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ছে। সর্বনাশা কৃষি আইনের প্রতিবাদে দেশের কৃষকরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নজিরবিহীন ঐতিহাসিক আন্দোলন এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে এ রাজ্য সহ বহু জায়গায় বিজেপি পরাজিত হয়েছেন। মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। প্রতিবাদী মানুষের এই ঐক্য ভেঙে দিতে আজ শাসকের হাতে অন্যতম প্রধান অস্ত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মানসিকতা খুঁচিয়ে তোলা। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে তারা আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখা তাস আবার বের করেছে। তাই এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সার্বিক গণআন্দোলন গড়ে তোলা আজ বড়ই প্রয়োজন। আমরা জানি অতীতে যেভাবে এনআরসি, এনপিআর, সিএএ-র বিরুদ্ধে এ দেশের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ এবং চিন্তাশীল নাগরিকেরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, এবারেও এই কালা নির্দেশের বিরুদ্ধে একইভাবে তীব্রতর আন্দোলন তাঁরা গড়ে তুলবেন।