নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর
ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
(২৭)
দেশে-বিদেশে বিদ্যাসাগর
১৮৬৪ সালে ফ্রান্সের একটি বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের কয়েকটি বই সাজানো রয়েছে দেখে খুব আশ্চর্য এবং অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বিদ্যাসাগরকে চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি দোকানদারকে বলেছি যে, এই লেখক (বিদ্যাসাগর) আমার পরম বন্ধু।’ এর দু’বছর পর লন্ডন থেকে আরেকটি চিঠিতে লণ্ডন থেকে মাইকেল বিদ্যাসাগরকে লিখেছেন, ‘তোমার কর্মকাণ্ডের কথা আমাদের কানে এসেছে এবং এখানকার ‘স্যাটার্ডে রিভিউ’ (১৮৫৫-১৯৩৮ পর্যন্ত প্রকাশিত লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিক)-এর আলোচনায় তোমাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে।’ বিদ্যাসাগরকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে মাইকেল লিখেছেন, ‘ডাক্তার গোল্ডস্টাকার একজন সত্যিকারের সংস্কৃত পণ্ডিত। নামে তোমাকে সে ভাল করে চেনে। বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গ নিয়ে এবং তোমাকে নিয়ে তাঁর সাথে আমার প্রচুর আলোচনা হয়েছে।’
বস্তুত, বিধবাবিবাহ আইন পাস (১৮৫৬), শিক্ষাসংস্কার, জেলায় জেলায় স্কুল স্থাপন ও বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে দাঁড় করানো– প্রধানত এই তিনটি বিষয়ের জন্য বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনকালেই সুখ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। উনিশ শতকের ভারতবর্ষে যে নবজাগ্রত চিন্তা তথা পার্থিব মানবতাবাদী জীবনবোধ বিদ্যাসাগরের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও কর্মধারার মধ্য দিয়ে দুর্দম ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার প্রখর উজ্জ্বলতায় আলোকিত এবং আন্দোলিত হয়েছে শুধু বাংলা-বিহার-ওড়িশা নয়, দেশের অন্যান্য প্রদেশও। এমনকি তৎকালীন ইউরোপের বিদ্বৎমহলেও তিনি বিশেষ ভাবে আলোচ্য হয়ে উঠেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহ আন্দোলন আসামে অতি দ্রুত গতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আসামের এক ঝাঁক শিক্ষিত তরুণ বিদ্যাসাগরের পথে অসমীয়া সমাজের অন্ধতা-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেমচন্দ্র বড়ূয়া, গুণাভিরাম বড়ূয়া, লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ূয়া প্রমুখ। হেমচন্দ্র বড়ূয়া (১৮৩৭-‘৯৭) একজন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী। এক শিশু কন্যাসন্তানকে রেখে তাঁর স্ত্রী প্রয়াত (১৮৬৫) হওয়ার পর আত্মীয়-বন্ধুরা তাঁকে আবার বিবাহ করতে বলেন। এটাই ছিল স্বাভাবিক। পুরুষরা একাধিক বিবাহ করবে, এর মধ্যে আশ্চর্য কিছু ছিল না। কিন্তু এই ঘটনাসূত্রে আসামে একটি নতুন ব্যাপার ঘটল। হেমচন্দ্র প্রকাশ্যে যুক্তি তুললেন, যদি পুরুষের একাধিক বিবাহ করার অধিকার থাকে, তাহলে নারীর কেন সে অধিকার থাকবে না? সাথে সাথে সমাজপতিরা আক্রমণ করল তাঁর বক্তব্যকে। হেমচন্দ্র শাস্তে্রর উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান যে, শাস্তে্র নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলা আছে। একই সাথে অসমীয়া ভাষাকে সংগঠিত করা এবং শিশু-কিশোরদের জন্য প্রাথমিক বইপত্র লেখারও সূচনা করেন।
আসামের আরেকজন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী গুণাভিরাম বড়ূয়া (১৮৩৭-‘৯৪)। তিনি কলকাতায় পড়াশুনা করতে এলে প্রত্যক্ষ ভাবে বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে এবং তাঁর সমাজসংস্কার ও শিক্ষাভাবনার সংস্পর্শে আসেন। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে প্রথম বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান হয়েছিল কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে, রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গুণাভিরাম। আসামে ফিরে গিয়ে তিনি বিদ্যাসাগরের উন্নততর জীবনবোধের আদর্শ প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিধবাবিবাহের সপক্ষে লেখালিখি শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অসমীয়া ভাষা এবং সাহিত্যে আধুনিকতার ভিতও রচনা করেন। তিনি ‘অরুণোদয়’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ‘বিধবা বিবাহ’ শিরোনামে লিখতে থাকেন। তাঁর ‘রাম নবমী’ (১৮৫৮) নাটকে তিনি ‘রাম’ এবং ‘নবমী’ চরিত্রদুটিকে কেন্দ্র করে বাল্যবিধবার যন্ত্রণা, তাদের ওপর সমাজের নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি তুলে ধরেন। তাঁর এই ভূমিকার কারণে অচিরেই আসামের রক্ষণশীল সমাজপতিরা যথারীতি তাঁকে বাধা দিতে শুরু করেন। কিন্তু বাধা অতিক্রম করে তিনি কাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে নিজেও বিধবাবিবাহ করেন।
আধুনিক ওড়িয়া কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ফকিরমোহন সেনাপতি (১৮৪৩-১৯১৮) এবং প্রখ্যাত হিন্দি কবি ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র (১৮৫০-‘৮৫) বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফকিরমোহন তাঁর ‘আত্মজীবনচরিত’-এ বিদ্যাসাগরকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করে খুবই আবেগঘন ভাষায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি যখন একসময় হতাশ এবং বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন তখন বিদ্যাসাগরের সহৃদয় সহায়তা ও ভালবাসায় অনুপ্রাণিত এবং উৎসাহিত হয়েছিলেন। ১৮৬৬ সালে ফকিরমোহন বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ওড়িয়াতে অনুবাদ করেন। তিনি ওড়িয়া সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের ব্যথা-যন্ত্রণা তুলে ধরেন। এর দ্বারা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই বিদ্যাসাগরের বহু গ্রন্থ ওড়িয়াতে অনুবাদ করেছেন। ১৮৯৮ সালে ফকিরমোহন লেখেন ‘রেবতী’। এই গল্পে কোমল শৈলীতে সমাজ-অভ্যন্তরে নারীশিক্ষার আকুতি সৃষ্টি করেন তিনি। তার সাথে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ নারীকে কী মর্মান্তিক অবহেলার চোখে দেখে, তাও তুলে ধরেন। গল্পের দশ বছরের মেয়ে ‘রেবতী’ ওড়িয়া সমাজে আজও একটা প্রতীকে পরিণত হয়ে আছে। নারীশিক্ষা বা অবহেলিত নারীর কথা এলেই লোকে ‘রেবতী’ নামটা ব্যবহার করে। এই প্রতীক ব্যবহার করে ওড়িয়া ভাষায় অসংখ্য গল্প লেখা হয়েছে। নন্দকিশোর বালা (১৮৭৫-১৯২৮)-এর ‘কনকলতা’ (১৯২৫) উপন্যাস থেকে বোঝা যায়, সে সময় ওড়িয়া তরুণদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের কী গভীর প্রভাব পড়েছিল। এই উপন্যাসে এক চরিত্রের সংলাপে নন্দকিশোর আক্ষেপ ব্যক্ত করে লিখেছেন, ‘‘ওড়িশাতে কি একজন বিদ্যাসাগর জন্ম নেবে না!” এই উপন্যাস পড়ে সেদিন অনেকে বিধবাবিবাহের সমর্থক হয়েছিলেন।
গুজরাটের বি এম মালাবারি (১৮৫৩-১৯১২) বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন। ১৮৮৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি প্রকাশ করেন ‘Notes on Infant Marriage and Enforced Widowhood’। বিদ্যাসাগরের মতোই তিনি রক্ষণশীলদের যাবতীয় কুযুক্তির তীব্র প্রতিরোধ করেন এবং আইন করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পক্ষে লড়াই চালান। এছাড়া, রমনলাল সোনি (১৯০৮-২০০৬) বিদ্যাসাগরের বই বাংলা থেকে গুজরাটি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। প্রসঙ্গত, রমনলাল স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩২ সালে জেলে গিয়ে বাংলা শেখেন। পরবর্তীকালে বেশ কিছু বাংলা সাহিত্য, বিশেষত শরৎচন্দে্রর ‘শ্রীকান্ত’, গুজরাটিতে অনুবাদ করেছেন। কলার্থী মুকুল ১৮৭৬ সালে গুজরাটি ভাষায় বিদ্যাসাগরের জীবনীও লিখেছেন। গুজরাটিতে প্রায় দশটি জীবনী আছে তাঁর।
‘মহারাষ্ট্রের বিদ্যাসাগর’ হিসাবে পরিচিত বিষ্ণু পরশুরাম পণ্ডিত (১৮২৭-‘৭৬)। তিনি বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক বই মারাঠিতে অনুবাদ করেন ১৮৬৫ সালে। বিধবাবিবাহের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি একটি সংগঠনও তৈরি করেন। নিজেও বিধবা কন্যাকেই বিবাহ করেছিলেন। তিনি ছাড়াও মহারাষ্ট্রের আরও কয়েকজন বিদ্যাসাগরের প্রভাবে সমাজসংস্কারের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্যোতিরাও ফুলে, গোপালহরি দেশমুখ, এম জি রানাডে প্রমুখ। নারীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ক্ষেত্রে জ্যোতিরাও ফুলে (১৮২৭-‘৯০) মহারাষ্ট্রের অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর সাহসী উদ্যোগেই ১৮৬৪ সালে মহারাষ্টে্র প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। গোপালহরি দেশমুখ (১৮২৩-‘৯২) বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালিখি করেছেন। এম জি রানাডে (১৮৪২-১৯০১) স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৮৬১ সালে মহারাষ্টে্র একটি সংগঠন (উইডো ম্যারেজ অ্যাসোসিয়েশন) তৈরি হয়েছিল। এতে রানাডের ভূমিকা ছিল। এই সংগঠনকে ভিত্তি করে বিধবাবিবাহের পক্ষে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়েছিল। এছাড়া, বালকৃষ্ণ লক্ষ্মণ বাপট-এর ‘বিধবাবিবাহ খণ্ডন’ ও কৃষ্ণ প্রভাকরের ‘পুনর্বিবাহ নিষেধ’ বই দুটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ নামে পরিচিত কান্দুকুরি বীরসালিঙ্গম (১৮৪৮-১৯১৯)। তিনি ১৮৭৬ সাল থেকে ‘বিবেক বর্ধিনী’ পত্রিকার মাধ্যমে মূলত নারীশিক্ষা ও বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য লেখালিখি শুরু করেন। বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল সমাজপতিরা তাঁকে বাধা দিতে গেলে তিনি বিদ্যাসাগরের মতোই শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে লড়াই চালান। ১৮৮০ সালে তিনি ‘উইডো রিম্যারেজ অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে তাঁর সদস্যদের গোটা অন্ধ্রপ্রদেশে ছড়িয়ে দেন। তাদের কাছ ছিল যুবকদের আধুনিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা, বিধবাবিবাহের পক্ষে জনমত তৈরি করা। সে সময়ে একাজ ওখানে বাংলার মতোই মারাত্মক কঠিন ছিল। বীরসালিঙ্গমের লাগাতার লড়াইয়ের পর ১৮৮১ সালের ১১ ডিসেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, তামিলনাড়ূতে এম ভি ভেঙ্কটরাম (১৯২০-২০০০) বিদ্যাসাগরের জীবনী লেখেন তামিল ভাষায়। জানা গেছে, ব্যাঙ্গালোরের বি ভেঙ্কটচারিয়া নামে জনৈক ব্যক্তি পোস্টকার্ড চালাচালি করে বিদ্যাসাগরের কাজ থেকে বাংলা শিখতেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাসাগরকে ‘অনারারি ফেলো’ মনোনীত করেছিল ১৮৮৩ সালে। পরবর্তী কালে ইংরেজি সহ উর্দু হিন্দি মারাঠি কন্নড় মলয়লাম ওড়িয়া পাঞ্জাবি তামিল তেলেগু ইত্যাদি প্রায় সমস্ত ভারতীয় ভাষায় বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বহু বইপত্র লেখা হয়েছে।
ইউরোপে বিদ্যাসাগরের চর্চার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল একটি জার্মান ভাষার পত্রিকা। তাঁর ১৭টি বইয়ের পর্যালোচনার জন্য ১৮৬৫ সালে ওই পত্রিকায় ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্য কৃতি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে লেখক ভাষা-সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের আশ্চর্য মুন্সিয়ানার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। এর আগের বছরই জার্মান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি তাঁকে ‘অনারারি ফেলো’ নির্বাচিত করে। ওই বছরই লন্ডনের ‘রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি’ও বিদ্যাসাগরকে ‘অনারারি মেম্বার’ মনোনীত করে। (চলবে)