নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর
ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷
(১৯)
বঙ্কিমচন্দ্র ও বিদ্যাসাগর
১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়েছিল৷ এর মধ্য দিয়ে এক কঠিন লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর৷ কিন্তু শুধু আইন দিয়েই যে সমাজ–মননের জড়তা, পশ্চাদপদতা ইত্যাদি দূর করা সম্ভব নয়, এ তিনি ভালভাবে জানতেন৷ তাই, এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এবং বিশেষত নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসারে বিদ্যাসাগর রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন৷ জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্কুল স্থাপন, শিক্ষক নিয়োগ, তাদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট প্রায় সমস্ত কর্মপ্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে তিনি যুক্ত থেকেছেন৷ এর মধ্যেই বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা এবং গদ্যকে ভাবপ্রকাশের উপযোগী করে তোলার জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন৷ এই সময়েই তিনি লিখেছেন অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তক, বই এবং ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৬), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০)’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’ (১৮৬৩), ‘শব্দমঞ্জরী’ (১৮৬৪), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯) ইত্যাদি৷
এই প্রায় পনেরো বছর ধরে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্যও সমাজের নানা স্তরে আলাপ–আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক, ঘরোয়া সভা ইত্যাদি চালিয়ে গিয়েছেন৷ সে–সবের ধারাবাহিকতায় ১৮৭১ সালের ৮ আগস্ট বিদ্যাসাগর যে পুস্তকটি লিখে প্রকাশ করলেন সেটি হল, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’৷ এই বইতে তিনি তথাকথিত শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের কু–তর্কের জবাব দিলেন৷ রক্ষণশীল পণ্ডিতসমাজ বলত, শাস্ত্রে বহুবিবাহের বিধান আছে৷ বিদ্যাসাগর শাস্ত্র উদ্ধৃত করে দেখিয়ে দিলেন, তাঁদের কথা ঠিক নয়৷ ওই পণ্ডিতসমাজের অনেকে তখন পাল্টা বই লিখে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করলেন৷ সে–সব বইতে যা বলা হয়েছিল, তার প্রত্যেকটি কথার জবাব বহু উদাহরণ সহ তুলে ধরে ১৮৭৩ সালের ২ এপ্রিল বিদ্যাসাগর আবার লিখে প্রকাশ করলেন, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (দ্বিতীয় পুস্তক)৷ বিদ্যাসাগরের বয়স তখন ৫৩৷ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদক এবং ওই পত্রিকাতেই ধারাবাহিক ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস লিখছেন৷ তাঁর বয়স তখন ৩৫৷ (উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালের ১ জুন৷)
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের বিষয় নরনারীর সম্পর্কভিত্তিক হলেও এর প্রধান আধার বিধবাবিবাহ এবং বহুবিবাহ৷ এই উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র একটি চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘বিধবাদের যে বিয়ে দেয় সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে?’ উপন্যাস শেষ করেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (দ্বিতীয় পুস্তক)–কে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে দীর্ঘ এবং অত্যন্ত আক্রমণাত্মক এক সমালোচনা লেখেন বঙ্গদর্শন পত্রিকায়৷ সেই সমালোচনায় তিনি মূলত যা বললেন তা হল, ‘বহুবিবাহ একটি নিন্দনীয় প্রথা৷ কিন্তু এই প্রথাকে সমাজ থেকে দূর করার জন্য শাস্ত্রীয় প্রমাণ দাখিল করার কোনও প্রয়োজন নেই, আইন করারও কোনও প্রয়োজন নেই৷ কারণ, এই প্রথার চল সমাজে এমনিতেই কমে এসেছে এবং বাকি যেখানে যেটুকু আছে, তা আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবে৷ তা ছাড়া, এদেশে মুসলিমরাও আছে, ফলে হিন্দুদের জন্য এক আইন আর মুসলিমদের জন্য আরেক আইন সম্ভব হবে না৷’ প্রসঙ্গত, এই অভিযোগগুলি কোনওটাই বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম করেননি৷ তাঁর আগেই রক্ষণশীল পণ্ডিতসমাজ এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন৷ এবং ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (প্রথম পুস্তক)’–এ বিদ্যাসাগর প্রত্যেকটি প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন৷
তারপরেও, এই অভিযোগগুলির সাথে বঙ্কিমচন্দ্র অভিযোগ করেন, ‘বিদ্যাসাগর নানা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি ইত্যাদি তুলে এনে প্রকাশ করেছেন নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য৷’ ওই সমালোচনায় বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ করেছেন যে, ‘বিদ্যাসাগর অন্যান্য মত খণ্ডন করতে গিয়ে অহেতুক শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের অপমান করেছেন৷’ বঙ্কিমচন্দ্র যৌবনের প্রারম্ভে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতেন, ‘তিনি ছেলেদের জন্য খানকতক বই লিখেছেন মাত্র৷’ বঙ্কিমচন্দ্র বলতেন, ‘বিদ্যাসাগর বড় বড় সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাঙলা ভাষার ধাতটা গোড়ায় খারাপ করে গেছেন৷’ বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ সম্পর্কেও বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্রূপ করেছেন৷
বঙ্কিমচন্দ্রের এহেন মতামতের জবাবে বিদ্যাসাগর লিখিতভাবে কখনও কোথাও কিছু বলেননি৷ বহু পত্র–পত্রিকা বিদ্যাসাগরের পক্ষ নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে বিস্তর গালমন্দ, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ করলেও বিদ্যাসাগর কিছুই লেখেননি৷ অমৃতবাজার পত্রিকা বহুবিবাহ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মতামত সমর্থন করলেও ২৬ জুন ১৮৭৩ সংখ্যায় লিখেছে, ‘‘বঙ্গদর্শন বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যা লিখেছে তা পাঠ করে আমরা দুঃখিত হলাম৷ …বিদ্যাসাগর মশাই দেশপূজ্য ব্যক্তি, তাঁর কোন ভ্রান্তি দেখলে আমরা দুঃখিত হয়ে তাঁকে বড়জোর দেখিয়ে দিতে পারি, সেজন্য তাঁকে ছলে কৌশলে লম্বা উপদেশ দিতে পারি না৷’’ এরপর ওই পত্রিকা (৩ জুলাই ১৮৭৩) লিখেছে, ‘‘বঙ্গদর্শন সম্পাদক (বঙ্কিমচন্দ্র) নতুন লেখক, সুতরাং তাঁর সহস্র অপরাধ মার্জ্জনীয়৷ আমাদের ভরসা, তাঁর মত সুবোধ সম্পাদক আরো একটু শিক্ষিত হলে এ ভ্রমের পুনরাবৃত্তি হবে না৷’’
বাস্তবে, সে সময়ে, বঙ্কিমচন্দ্রের দাবি অনুযায়ী, বহুবিবাহ যে সমাজে অচল হয়ে আসছে না, বরং পুরোমাত্রায় বহাল রয়েছে, সে বিষয়ে বিদ্যাসাগর নিজে গ্রামভিত্তিক সমীক্ষা করে তথ্য–পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছিলেন৷ প্রায় তিনশো ব্যক্তির নাম–ধাম, বয়স এবং বিবাহের সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন, যাকে কেউই অস্বীকার করতে পারেননি৷ দ্বিতীয়ত, বহুবিবাহ রদ করার জন্য আইন করা কেন প্রয়োজন সে বিষয়েও বিদ্যাসাগর বিস্তৃত আলোচনা করে দেখিয়েছিলেন৷ তৃতীয়ত, মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে যে ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তার জবাবও বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন৷ ‘বহুবিবাহ’ সংক্রান্ত তাঁর প্রথম বইতে পর পর সে সমস্ত আলোচনা রয়েছে৷ সেগুলি কেউই খণ্ডন করতে পারেননি৷
সংস্কৃত শব্দ বিদ্যাসাগরের চেয়ে বঙ্কিমচন্দ্রই ব্যবহার করতেন বেশি৷ তাই, তাঁর উপন্যাস পড়া আজও এক অতি কঠিন কাজ সাধারণের পক্ষে৷ ‘সীতার বনবাস’ নিয়ে সে সময়েই বিদ্বৎমহলে যে প্রবল উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল তা বঙ্কিমচন্দ্রের বিদ্রূপকে টিকতে দেয়নি৷ এমনকি এই বই সাধারণ পাঠকেরও হৃদয় স্পর্শ করেছিল৷ ‘সীতার বনবাস’ সম্পর্কে অসংখ্য বিদ্বজ্জনের অগণিত শ্রদ্ধার্ঘ্যের প্রকাশ ঘটেছে৷ তবু, বঙ্কিমচন্দ্র তো দ্বিমত হতেই পারেন৷ সম্ভবত সে কারণেই বিদ্যাসাগর কোথাও কখনও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে কোনও বিরূপ কথা বলেননি, লেখেননি৷ সম্ভবত সে–যুগে দাঁড়িয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশ্ণশীল মনকে, যৌবনের তেজকে তিনি কোনওভাবে নিরুৎসাহিত করতে চাননি৷ সম্ভবত বিদ্যাসাগর ভেবেছিলেন, হোক আমার সমালোচক, কিন্তু বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো প্রতিভাবানের বিশেষ প্রয়োজন আছে৷
তাই, যখন একদিন এক ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের কাছে এসে বঙ্কিমচন্দ্রের চরিত্র নিয়ে নানা কুৎসা করছে, বঙ্কিমচন্দ্র কীভাবে রাত কাটান তার বিশ্রী বর্ণনা দিচ্ছে, তখন বিদ্যাসাগর বুঝলেন ব্যক্তিটি তাঁকে ‘বঙ্কিম–বিরোধী’ ভেবে তোষামোদ করছে৷ বিদ্যাসাগর সব শুনে প্রথমে খুব হাসলেন৷ তারপর মজা করে বললেন, ‘‘লোকটা (বঙ্কিমচন্দ্র) সমস্ত দিন গভর্নমেন্টের কাজে ব্যস্ত থাকে৷ আবার রাত্রেও যদি ওই রকমে কাটায়, তাহলে বই লেখে কখন? তার কেতাবে যে আমার আলমারির একটা সেলফ ভরে গেল৷ ও হে, তোমার কথা শুনে তো বঙ্কিমচন্দ্রের ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল৷’’ এই ছিলেন বিদ্যাসাগর৷
বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরকে চিনতে পেরেছিলেন৷ তাই বিদ্যাসাগর আঘাত পেতে পারেন ভেবে ওই ধরনের অহেতুক আক্রমণাত্মক লেখা আর কখনও বঙ্কিমচন্দ্র লেখেননি৷ বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পরে বহুবিবাহ পুস্তকের ওই সমালোচনামূলক প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্র একটি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেছেন৷ কিন্তু তা করেছেন প্রবন্ধটির অনেক অংশ বাদ দিয়ে, শুধু মতবিরোধ অংশটুকুমাত্র রেখে, ব্যক্তিগত আক্রমণের অংশগুলি সযত্নে বর্জন করে৷ ঘটনা হল, বিদ্যাসাগরের অগাধ পাণ্ডিত্য, সামাজিক সক্রিয়তা, বিরলতম দরদি মন ইত্যাদিকে পরিণতমনস্ক বঙ্কিমচন্দ্র কোনও ভাবেই অস্বীকার করেননি, করতে চাননি৷ বিশেষত, বাংলা গদ্যে, ভাষায়, সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক অবদান স্বীকার না করে তিনি পারেননি৷ তাই বঙ্কিমচন্দ্রই এক সময় বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর৷ তাঁহার পূর্বে কেহই এমন সুমধুর বাঙ্গালা লিখিতে পারে নাই, এবং তাঁহার পরেও কেহ পারে নাই৷’’ বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচিত ও গঠিত বাংলা ভাষাই আমাদের মূলধন৷ তাঁরই উপার্জিত সম্পত্তি নিয়ে নাড়াচাড়া করছি৷’’ এমনকি তিনি বিদ্যাসাগরের লেখা নিয়ে প্রবন্ধ সংকলনও প্রকাশ করেছেন৷(চলবে)