পোশাক দেখেই চেনা যায় অশান্তি কারা পাকাচ্ছে– সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ৩০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে অন্তত দু’টি জায়গায় রামনবমীর মিছিলে রিভলবার হাতে নৃত্য করা যুবকদের ছবি দেখেও তিনি কিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন কি না, তা দেশবাসীকে জানালে বড় ভাল হত।
বিগত কয়েকটা বছর ধরে রামনবমীর দিনটা এলেই শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের বুক-ঢিপঢিপ শুরু হয়ে যায়– কখন শুরু হবে অশান্তি, আক্রমণ, লুঠপাট, ঘরে-দোকানে আগুন লাগানো, ধর্মস্থান ভাঙা, খুন, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক হানাহানি! দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে রামনবমীর মিছিল থেকে এই বছরও নানা হাঙ্গামা হয়েছে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশের একাধিক জায়গায় প্রাণহানি, রক্তপাত, হাঙ্গামা, বাড়িঘর-দোকানে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গও বাদ যায়নি।
বিপুল হুঙ্কারে আক্রমণোদ্যত হনুমানের ছবিওয়ালা পতাকা উড়িয়ে, অস্ত্রের উলঙ্গ আস্ফালন এবং কানফাটানো ডিজের অনুষঙ্গে রামনবমীর মিছিলের যে হিড়িক শুরু হয়েছে, তার সাথে ধর্ম এবং ধর্মাচরণের যোগসূত্র কী থাকতে পারে? কার্যত তা নেইও। ভক্তিপ্রদর্শনই ধর্মের নাম করে মিছিলের উদ্দেশ্য হলে তা বারবার অন্য ধর্মের মানুষের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠার কথা নয়। এমন ঘটনা একটা দুটো বিচ্ছিন্ন জায়গায় ঘটলেও না হয় বলা যেত, এর পিছনে বিশেষ অভিসন্ধি নেই। কিন্তু তা যখন সারা দেশের বহু জায়গার চিত্র হয়ে ওঠে, তাকে নিছক আবেগের বশে ঘটিয়ে ফেলা ঘটনা বলা যায় না। এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং সংগঠিত না হলে এমনটা একই সাথে বহু জায়গায় ঘটতে পারত কি? ক্ষমতা প্রদর্শনের এই রকম মিছিলের সাথে সাধারণ মানুষের ধর্মাচরণ কিংবা ভক্তির যোগ কিছুমাত্র নেই। এর সাথে একমাত্র যোগ আছে অতি কু৩সিত ধুরন্ধর ভোট রাজনীতির। যে কারণে বিজেপির প্রায় সমস্ত নেতাই রামনবমীর মিছিলকে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অবশ্যপালনীয় অংশ করে ফেলেছেন। বিজেপি শাসিত নানা রাজ্যে দেখা গেছে নিয়ম করে অশান্তি ছড়ানো এবং হাঙ্গামা বাধানোর কাজে বিজেপির এমএলএ, এমপিরা পর্যন্ত নেমে পড়েছেন। একই রকমের ভোট রাজনীতির স্বার্থে বঙ্গীয় তৃণমূল নেতারাও হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ান হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে মহা উrসাহে রামনবমীর হিড়িকে পা মিলিয়েছেন। কংগ্রেস নেতারাও এই রাজনীতিই করে এসেছেন।
সম্প্রতি দেশের ক্রমবর্ধমান ঘৃণা-ভাষণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেছেন, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করার ফলেই অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনা মদত পাচ্ছে। রামনবমীকে ঘিরে বারবার যা ঘটছে, সে প্রসঙ্গেও একই কথা অবশ্যই বলা যায়। হাঙ্গামা, অশান্তিতে কোথাও হিন্দুত্ববাদীরা বেশি দায়ী, কোথায় তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা বেশি সক্রিয়। দুটোই নিন্দনীয়। তার থেকে অনেক বেশি নিন্দনীয়– এর হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান করা একদল ধুরন্ধর রাজনীতিক এবং ‘গোদি মিডিয়া’ বলে পরিচিত এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহাহুঙ্কারে বলেছেন, তিনি নাকি দাঙ্গাবাজদের উল্টো করে ঝোলাবেন। কিন্তু তাঁর দল এবং সহযোগীরাই তো বারবার দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত! তিনি তাদেরও ঝোলাবেন তো?
আসলে তাঁরা সংকীর্ণ স্বার্থে জনগণের মধ্যে চরম সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়াতে সর্বদা সচেষ্ট। তাতে হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
কয়েক বছর আগেও অন্তত বাংলার মাটিতে রামনবমী নিয়ে কোনও হইচই ছিল না। রামায়ণের চরিত্র রাম বাংলার মানুষের ভক্তি অর্জন করলেও রামনবমীর সাথে বাংলার ঐতিহ্য-রীতি-সংস্কৃতির যোগ বিশেষ নেই। বরং এই সময় বহুকাল ধরে বাংলায় পালিত হয়ে এসেছে বাসন্তী পুজোর উrসব। সাধারণ মানুষের সেই ধর্মাচরণের মধ্যে হুঙ্কারও নেই, অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষও নেই। সেই পশ্চিমবঙ্গেও রামনবমীকে প্রায় দলীয় কর্মসূচিতে পরিণত করে ফেলেছে বিজেপি এবং তাকে ঘিরে অশান্তি ঘটেই চলেছে।
২০১৮-তে আসানসোলে রামনবমীর মিছিলের নামে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা এবং হত্যা এ রাজ্য দেখেছে। একই সাথে দেখেছে ইমাম ইমদাদুল রশিদিকে, যিনি দাঙ্গায় সন্তান হারানোর মর্মবেদনা বুকে চেপে রেখে শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষার জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে নানা জায়গায় পরপর কয়েক বছর এই উপলক্ষে অশান্তি, হাঙ্গামা হওয়ার নজির থাকায় রাজ্য প্রশাসন সতর্ক থাকবে এটাই ছিল রাজ্যবাসীর আশা। কিন্তু দেখা গেল এবারেও হাওড়া এবং রিষড়াতে হাঙ্গামা অশান্তি ঘটতে পারল পুলিশের উপস্থিতিতেই। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও পুলিশের গাফিলতির কথা প্রথম দিনেই বলেছেন। তিনি কাউকে ছাড়া হবে না বলে হুঙ্কার দিতে পারেন, কিন্তু সারা রাজ্যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জড়ো হচ্ছে এই খবরটাও তাঁর সরকারের পুলিশ রাখতে পারল না কেন এর উত্তর তো তাঁকেই দিতে হবে। রামনবমীকে কেন্দ্র করে হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকাকে কার্যত দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হতে দিয়েছে প্রশাসন। ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার সাথে শাসকদলগুলির আপস করার মূল্য এভাবেই জনগণকে চোকাতে হচ্ছে।
রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে ওঠা সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এখন জনমানস প্রবল বিক্ষুব্ধ। এর সাথে সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকদের ন্যায্য ডিএ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সমস্ত পদে স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে তাতেও সরকার চাপে। প্রশ্ন উঠেছে পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই সমস্ত বিষয় থেকে মানুষের চোখ ঘুরিয়ে দিতেই কি এই হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণে ঢিলেমি? এটা কি ঘটতে দেওয়া হল?