ভোট দেওয়ার আনন্দে নেশা করে বেদম নেচেছে বিজলু গাওয়াই৷ সঙ্গে ছিল মদ আর শুয়োরের মাংস৷ ভোটের নাচ বলে কথা ভোট বাবুদের দেওয়া করকরে ৫০০ টাকার নোটটা যে পাগল করে তুলেছিল তাকে৷ বিজলু ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়ার জঙ্গল ঘেঁষা এক গ্রামের আদিবাসী মানুষ৷ নানা রঙের ভোটবাবুদের কাছে তাঁর পরিচয় অবশ্য একটিই– ‘ভোটার’৷
অফুরন্ত প্রাকৃতিক আর জনসম্পদে সমৃদ্ধ এক বিশাল দেশ ভারতের নাগরিক বিজলু গাওয়াই৷ সেই ভারত, যেখানে ‘আচ্ছে দিনে’র প্রতিশ্রুতিদাতা মসিহা প্রধানমন্ত্রীর আসন আলো করে থাকেন৷ যে ভারত নাকি ক্রমাগত ডিজিটাল আর উন্নয়নের প্রতীকে পরিণত হচ্ছে৷ যে ভারত গর্ব করে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসাবে৷ যে ভারত দুনিয়ার প্রথম সারির ধনীদের অন্তত দশ জনের বাসস্থান৷ যে ভারতের স্বাধীনতার সৈনিকরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দারিদ্র–অনাহার–বেকারি-অশিক্ষা-লাচারি-বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মতো অভিশাপকে দেশ থেকে চিরতরে দূর করে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পার করে সেই ভারতের সদ্য হয়ে যাওয়া কয়েকটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজলুর মতো অসংখ্য ভোটারদের চিন্তা কী? কোন ইস্যু নিয়ে ভোটপ্রার্থী দলগুলি গেল তাদের কাছে?
উন্নত জীবন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, কাজের সুযোগ, কৃষির উন্নতি, উন্নত সেচ না, এর কোনওটাই নয়৷ ছত্তিশগড়ের কথাই ধরা যাক, বিজেপি ক্ষমতায় আছে ১৫ বছর৷ তার আগে অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশকে ধরলে কংগ্রেসও স্বাধীনতার পর থেকে এই এলাকায় রাজত্ব করেছে বছরের পর বছর৷ এতই দিয়েছে যে আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তুলে ধরতে হয় ‘চাউল ওয়ালে বাবা’ হিসাবে মানে চাল বিলি করেন যিনি৷ ভোটের আগে দরিদ্র মানুষদের কাছে চাল বিলি, গাঁও মোড়ল বা তাদের ছেলেদের হাতে মোবাইল ফোন বিলি, বিজলুর মতো নিতান্ত সাধারণ ভোটারদের হাতে ৫০০ করে টাকা, মদ আর শুয়োরের মাংস বিলিই ছিল বিজেপির ভোট হাতিয়ার৷ গোপনে নয়, প্রকাশ্যে৷ এমনকী কংগ্রেসের অভিযোগ খণ্ডন করতে গিয়ে দান্তেওয়াড়ার বিজেপি সভাপতি বলেই দিয়েছেন, ‘কংগ্রেস ২৫০ করে টাকা দিতে পেরে আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে বলেই এত গায়ের জ্বালা তাদের’৷ কংগ্রেসও তা অস্বীকার করেনি৷ বিজেপি না কংগ্রেস কে জিতবে? সংবাদমাধ্যমের চর্চায় এ নিয়ে বাজার যতই সরগরম হোক, মানুষের জীবনে তার পার্থক্য এই একটু কম বেশিতেই৷
কিন্তু কেন? এমন লক্ষ লক্ষ বিজলুর খাটার মতো দুটো হাত তো খসে যায়নি? কালো কালো পেশিবহুল শরীরগুলোর আগুন জ্বলা পেটের খোরাক তারা আজও ঘাম ঝরিয়ে নিজ মেহনতে মাথা উঁচু করে অর্জন করতেই তো চায় তাহলে খয়রাতির চাল আর বাবুদের ছুঁড়ে দেওয়া ভিক্ষাতেই ভরসা কেন? কেন চাল বিলি করলেই আজও গরিবের মসিহা সেজে মানুষকে ভোলানো যায় কেন ভোটবাবুদের দেওয়া মদের নেশায় চুর হয়ে ভোটের নাচেই কষ্ট ভুলতে হয় বিজলু গাওয়াইদের?
উত্তরটা একেবারে অজানা নয়৷ ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে বিজলু গাওয়াইরাও তার উত্তর পেয়ে যেতে পারে৷ ছত্তিশগড় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিপুল বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, শিল্প সম্পদ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগে কাদের? কোটি কোটি টাকার মালিক দেশি–বিদেশি ধনকুবেরদেরই নয় কি? তাদের মালিকানায় কারখানা যখন হয়, সরকার বলে উন্নয়ন, শিল্পায়ন– তাতেও বিজলুদের সর্বনাশ৷ তাদের ভিটেমাটি পর্যন্ত উচ্ছেদ হয়৷ রাতারাতি বিজলুদের অন্ধকার গাঁ আলোয় ঝলসে যায় যেন৷ চাষবাস হারানো বিজলুদের সেই কারখানায় কিংবা তার বাবুদের বাড়িতে ঝি–চাকর বা মালি হিসাবে যদি বা একটা আধপেটা মাইনের লেবারের কাজ মিলল, কদিন বাদেই কারখানা বন্ধ৷ তখনও সর্বনাশ ঘনায় বিজলুদেরই উপর৷ মালিকরা আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে৷ মালিকদের, এমএলএ–এমপিদের উন্নয়ন যত হয় বিজলুরা তলিয়ে যায় আরও আরও অতলস্পর্শী অভাবের হাঁ করা খাদে৷
পেটের ভাতের জন্য মেহনতের পাশাপাশি এসব কথাও ভাবে যে মজুর চাষি, যদি ভাবে গণতন্ত্র দিয়েছে ভোটের অধিকার, তাকে বেচে দেব কেন? মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে অধিকার যদি তারা বুঝে নিতে চায়? সে চাষি–মজুরকে যে বড় ভয় সরকারি ক্ষমতার সিংহাসনের চারপাশে ঘুরঘুর করা ভোটবাজ নানা রঙের নেতাবাবুদের৷ এমন করে অধিকার চাইতে চাইতে একদিন যদি বিজলুরা ওই ছত্তিশগড়ের জল–জঙ্গল–মাটিতে থাকা কুবেরের ভাণ্ডারের অধিকারও দাবি করে বসে? যদি পৌঁছে যায় এমন বোধে যে, এই সমাজের সব কিছুর স্রষ্টা শ্রম৷ তার জন্যই সব অধিকার দাবি করে বসে? কংগ্রেস–বিজেপির মতো দলগুলি যাদের কেনা গোলাম সেই পাহাড় প্রমাণ পুঁজি মালিকদের তো তাতে সমূহ সর্বনাশ৷
তাই শুধু ছত্তিশগড় নয়, সারা ভারতেই ভোটের বাজারে উন্নয়ন মানে সরকারি দলের কথায় ঘুরে ফিরে আসে ২ টাকা কেজি চাল, সাইকেল বিলি, মোবাইল বিলি, কন্যাশ্রীর মতো ডোল বা খয়রাতির কথা৷ নেপথ্যে গ্রাম–শহরে বইয়ে দেওয়া হয় মদের বন্যা৷ দেদার টাকা উড়িয়ে ভোটবাজ দলগুলি তাদের ধনকুবের প্রভুদের হয়ে ভোটের নামে জীবনটাকেও কিনে নেয় বিজলুদের মতো সাধারণ মানুষের৷ এরই নাম হল বুর্জোয়া গণতন্ত্র ভোট নামক গণতন্ত্রের উৎসবের উন্মাদনায় সরকারের সাইনবোর্ড পাল্টায় বিজলুদের জীবন পাল্টায় না৷
(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)