২০২১-এ ভারতে কৃষির সঙ্গে যুক্ত ১০,৮৮১ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৫,৩১৮ জন কৃষক ও ৫,৫৬৩ জন কৃষি শ্রমিক। এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরো (এনসিআরবি)। যদিও আসল সংখ্যাটা আরও বেশি। কারণ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা সহ ১১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কৃষির বিপর্যয়ের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা আলাদা করে রেকর্ড করা হয় না। এই জায়গাগুলিতে কৃষক, খেতমজুর, ভাগচাষিরা আত্মহত্যা করলেও তাকে প্রশাসন পারিবারিক বিবাদ, নেশায় আসক্তি বা অসুস্থতা জনিত হতাশার কারণে আত্মহত্যা হিসাবে দেখায়। তাই তাদের তালিকায় আত্মঘাতী কৃষক ও ভাগচাষির সংখ্যা শূন্য। রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২১ সালেই কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন সবচেয়ে বেশি।
এই পরিসংখ্যানে দেশের বিবেকবান সাধারণ মানুষ মাত্রেই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ভাবলেশহীন। তিনি এবং তাঁর দল বিজেপি একদিকে অমৃত মহোৎসবের নামে বিভিন্ন শিলান্যাস, বাণী বিতরণ, জৌলুসপূর্ণ সরকারি অনুষ্ঠান প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত। অন্যদিকে ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মাননিধি যোজনা’য় কত মানুষ টাকা পাচ্ছে তার সাড়ম্বর ঢাক পেটানোর পর তাদের আর সময় কই কৃষকদের বাঁচা-মরার খবর রাখার? যে বিশাল কৃষক সমাজ দেশের মানুষের অন্ন যোগান দেয়, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খাদ্যশস্য ও শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদন করে তাদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, জ্বালা-যন্ত্রণার খবর নেওয়ার সময় মন্ত্রী, আমলা, সরকারি নেতাদের নেই। এই দরিদ্র মানুষগুলির দুবেলা খাবার জোটে কি না, এদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ কতটুকু পায়, এদের চিকিৎসার সুযোগ আছে কিনা বা চাষের সময় নেওয়া ঋণ চাষিরা শোধ করতে পারল কিনা, উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম চাষিরা পেল কিনা– সরকারি কর্তারা চান এসব সত্য যেন চাপাই থাকে। না হলে প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারতের ফানুস ফেটে যাবে।
রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকদের আত্মহত্যার ৮০ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অন্ব্র+প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাডুতে। এর মধ্যে মহারাষ্টে্র ২০২১ সালে আত্মঘাতী হয়েছেন ৪০৬৪ জন কৃষক। এদের বেশিরভাগই নিজের জমিতে ফসল ফলাতেন এবং বাকিরা হয় ভাগচাষি বা কৃষিশ্রমিক। দেশে প্রতিদিন অন্তত ১৫ জন করে কৃষক ও ১৫ জন কৃষিশ্রমিক বা ভাগচাষি আত্মঘাতী হওয়ার বিষয়টিও সামনে এসেছে রিপোর্টের মধ্য দিয়ে। এই চিত্র দেশের কেমন উন্নয়ন বা আত্মনির্ভরতার নিদর্শন তার উত্তর নিচয়ই বিজেপি নেতারা দেবেন না। দেশের কিছু কৃষককে বছরে ৬০০০ টাকা খয়রাতি করে যে কৃষক পরিবারগুলিকে বাঁচানো সম্ভব নয়, তা তো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, বহু রাজ্যে প্রাপকদের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে, কারণ সরকার বরাদ্দ কমাচ্ছে। এও তো অজানা নয় যে, বেশিরভাগ চাষি জমিতে চাষ করার জন্য ঋণ নিতে বাধ্য হয় চড়া সুদে। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে যে টাকা সে পায় তাতে তার চাষের খরচ ওঠে না। সুদ সহ ঋণের মোটা টাকা সে পরিশোধ করতে পারে না। কখনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থায় চাষিকে নূ্যনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে পারে একমাত্র সরকার ও তার প্রশাসন।
দেশে এতদিন আইন থাকলেও কোনও সরকারই চাষিকে ফসল বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সব সরকারই পরিচালিত হয়েছে কালোবাজারি, মজুতদার ও পুঁজিপতিদের মুনাফার স্বার্থে। তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষকদের জয় কিছুটা হলেও অর্জিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি সত্যিই কৃষকদরদি হত, তবে কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পায়, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ, সার, কৃষি সরঞ্জাম, বীজ, কীটনাশক এবং সেচ ব্যবস্থা যাতে সুলভ হয় তার ব্যবস্থা করত। এসবের কোনও ব্যবস্থা তারা করেনি। আড়তদার ও মজুতদারদের যে রমরমা কালোবাজারি দেশ জুড়ে চলছে তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা সরকার নেয়নি। শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে কিছু কৃষকের হাতে সামান্য খয়রাতি তুলে দিয়ে ফলাও করে তার প্রচার করার ব্যবস্থা করেছে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ফসলের দাম না পেয়ে বা কৃষি শ্রমিকরা সারা বছর কাজ না পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের আত্মঘাতী হওয়া থেকে বাঁচানোর একমাত্র পথ হতে পারে দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের একচেটিয়া পুঁজির তোষণ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের ভ্রান্ত কৃষিনীতিকে রুখে দিতে সংগঠিত হওয়া ছাড়া রাস্তা নেই।