Breaking News

দেশে প্রতি চার জনে একজন দিনমজুর আত্মহত্যা করেন

ভারতে যত মানুষ আত্মহত্যা করেন, তাঁদের প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন দিনমজুর। সংসদে গত বছরের শেষ দিকে এক প্রশ্নের উত্তরে ২০১৯-২১ সালের এই তথ্য পেশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১-এ আত্মঘাতী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ১২ হাজার। ২০২১ সালে প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

এই দিনমজুরদের মধ্যে যেমন রয়েছেন খেতমজুর তেমনই রয়েছেন নানা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ। সরকার বা প্রশাসন আত্মহত্যার কারণ হিসাবে পারিবারিক সমস্যা, অসুস্থতা, ড্রাগ ও মদের নেশাকে দায়ী করে। কিন্তু বাস্তবটা তা নয়। যুক্তির খাতিরে যদি এগুলিই মজুরদের আত্মহত্যার কারণ ধরে নেওয়া হয়, তা হলেও সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?

বাস্তবে আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলি হল– ন্যায্য মজুরি এমনকি প্রাপ্য মজুরিও না পাওয়া, স্বল্প বা অনিয়মিত আয়, কাজের অনিশ্চয়তা, কাজের অত্যধিক সময় ও অমানুষিক চাপ, ছাঁটাই, ঋণের ভার এবং ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রমবর্ধমান আর্থিক দুরবস্থা। এ ছাড়া অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ অত্যন্ত অমানবিক। শ্রমিকদের জন্য সোসাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামেই রয়েছে, নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক হওয়ার কারণে এঁদের দাবিদাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে জানানোর জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা। শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা যতটুকু ছিল, নতুন লেবার কোড চালু করে মোদি সরকার সেটাও কেড়ে নিয়েছে।

২০২০-২১-এ করোনা অতিমারির কারণে বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থা তাদের ঝাঁপ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সেই সব সংস্থার কর্মী সহ অসংখ্য মানুষ রোজগার হারিয়েছেন। তারপর আর সুদিন দেখতে পাননি তারা। তারা পরিজনদের বাঁচাতে হন্যে হয়ে যে কোনও একটা কাজকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু কোথায় কাজ! সরকারের কর্মসংস্থানের প্রচারই সার। অনেকেই ধার করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু মেটাতে পারেননি দেনা। কোথাও কোনও দিশা দেখতে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে।

মজুররা যাতে আত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য না হন, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে, রাজ্য সরকারগুলিই বা কী পদক্ষেপ নিয়েছে? সংসদে উত্তর দিতে গিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ যাদব অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য নানা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, বিমা, স্বাস্থ্যবিমার উল্লেখ করেই দায়িত্ব সেরেছেন। খেতমজুরদের প্রাপ্ত মজুরি জীবন নির্বাহের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কি না, তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে তাদের মজুরি-বৃদ্ধি নিয়েও সরকারের কোনও ভাবনা নেই। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে মনগড়া হিসাবে মজুরি নির্ধারণ করছে সরকার, যাতে পরিবারের সব খরচ চলা দূরের কথা, পেট চালানোই দায়।

যে একশো দিনের প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ ক্ষেত্রের বহু মানুষ অল্প কিছু হলেও রোজগার করেন, তাতেও বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে সরকার। জবকার্ডের সাথে আধার কার্ডের বা ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ হয়নি এ রকম নানা কারণে গত ছয় মাসেই শুধু ৩৯ লক্ষ শ্রমিকের নাম মুছে দেওয়া হয়েছে ১০০ দিনের প্রকল্প থেকে। মূল্যবৃদ্ধি রোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলিকে কিছুটা সুরাহা দিতে পারত সরকার, তারও কোনও উদ্যোগ নেই। রাজ্য সরকারও কেন্দ্রের দিকে আঙুল তুলেই দায়িত্ব সেরেছে।

মালিকরাই যে আসলে শ্রমিকদের বঞ্চিত-শোষিত করে তাদের বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি করে, শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য যে মালিকরাই দায়ী, সে কথা প্রকাশ না করে শ্রমিকদের দিকেই আঙুল তুলে মালিক বলে– শ্রমিকরা অসাধু, উচ্ছৃঙ্খল, ইন্দ্রিয়াসক্ত। বলে, তাদের অসংযত চরিত্রই তাদের সব দুঃখকষ্টের মূল। কিন্তু আসলে শ্রমিকের দুঃখকষ্টের মূল কারণ যে মালিকী শোষণ, তা আড়াল করে। অন্য দিকে উৎপাদনকারী শ্রমিককে উৎপাদিত সম্পদের মালিক মানতে অস্বীকার করে।

পুঁজিবাদী এই উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিকের সেবাদাস সরকারগুলি যে নীতি নির্ধারণ করে, তাতে শ্রমিক-শোষণের স্টিমরোলার চালাতে সুবিধা হয় মালিকদের। তাদের মালিক-তোষণ নীতির কারণেই এত বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাইয়ের বাড়বাড়ন্ত। দু’বেলা প্রাণপাত পরিশ্রম করেও সাধারণ মানুষের জীবনে আনন্দের লেশমাত্র নেই, রয়েছে হাজারো সমস্যার ঘনঘটা। সেজন্যই অনেক মজুর আত্মহত্যা করে জীবনের যন্ত্রণা এড়ানোর চেষ্টা করে।

এই ব্যবস্থার কানাগলি থেকে বেরনোর জন্য চাই সঠিকশ্রেণিচেতনার ভিত্তিতে সঠিক নেতৃত্বে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজুরদের আপসহীন লড়াই।