‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ করার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই বিকাশের জন্যই নাকি তুমুল গতিতে আর্থিক সংস্কারের জয়রথ বিজেপি সরকার ছুটিয়ে চলেছে। কিন্তু কার বিকাশ হয়েছে? ‘সংস্কার’ করে কোন অন্যায় শুধরানোর ব্যবস্থাই বা করেছেন তাঁরা? সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ‘বিকাশ’ আর ‘সংস্কারের’ ধাক্কায় দেশের সম্পদ ক্রমাগত গিয়ে জমা হচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের হাতে। স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলিতে যারা পুঁজি ঢালে সেই সব কোম্পানির মাথারা প্রধানমন্ত্রীর যে ভাবে স্তুতি গাইছেন তাতে আবারও তা প্রমাণ হল। ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ওই সাক্ষাতে ধনকুবেররা বলেছেন, আর্থিক সংস্কারের দাক্ষিণ্যে তাঁরা দশ বছরে ৭০টি ইউনিকর্নের (স্টার্টআপ সংস্থা যাদের সম্পদ-মূল্য ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি) মালিক হয়েছেন। এমনকি এই অতিমারির সময়ে ২০২১-এ তাঁরা ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন।
অন্যদিকে তখনই দেখা যাচ্ছে ভারত ‘এগোচ্ছে’ ভয়াবহ দারিদ্র ও চরম বৈষম্যের দিকে। ২০২১-এর ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট’ এই ভয়াবহ আর্থিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছে। রিপোর্ট বলছে, ভারতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পুঁজিপতির সিন্দুকে রয়েছে ৫৭ শতাংশ মানুষের মোট আয়ের সমপরিমাণ সম্পদ। নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষকে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ নিয়েই দিন গুজরান করতে হচ্ছে। কংগ্রেস ও বিজেপির দীর্ঘ শাসনে ভারত ‘শ্রেষ্ঠ’ আসন পেয়েছে বৈষম্যে-দারিদ্রে। বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় বিশ্বের ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৩। নারীদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও প্রকট। জাতীয় আয়ে মহিলা শ্রমিক-কর্মীদের ভাগ মাত্র ১৮ শতাংশ। এই হার গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম।
ভারতে ৮১ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে
২০২১ সালে ফোর্বস পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পদশালীদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে করোনার এই বিপর্যয়ের মধ্যেও দেশের প্রথম সারির ধনকুবেরদের সম্পদ এক বছরে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার থাবায় অর্থনীতির সংকট তীব্র এবং সাধারণ মানুষের রুটি-রুজি ধ্বংস হয়েছে, চাকরি নেই কোটি কোটি মানুষের। ইউনাইটেড নেশন ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষা বলছে, বিশ্ব ব্যাঙ্ক নির্ধারিত দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা (দৈনিক প্রায় দুশো তেতাল্লিশ টাকায় পরিবারের সকলের জীবনধারণ) অনুযায়ী ভারতের ৬০ শতাংশ (প্রায় ৮১ কোটি ২০ লক্ষ) মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন। লকডাউনের পরবর্তী পর্যায়ে তা পৌঁছে গেছে প্রায় ৯২ কোটিতে। এ দেশের সরকারগুলির বিশেষত বর্তমান বিজেপি সরকারের কার্যকলাপ দেখলে যে কেউ বুঝবেন, আসলে এই পরিসংখ্যানও হিমশৈলের চূড়ামাত্র। সরকার কখনও প্রকৃত দারিদ্রের সংখ্যা প্রকাশ করে না।
বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বৈষম্য ভয়ানক
দেখা যাচ্ছে, করোনা-সঙ্কটে বিশ্ব জুড়েই ধনকুবেরদের সম্পদের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। বিশ্বের ২৭৫০ জন বিলিওনেয়ারের হাতে রয়েছে পৃথিবীর ৩.৫ শতাংশ সম্পদ। ১০ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে রয়েছে বিশ্বের ৭৬ শতাংশ সম্পদ। অর্থাৎ সম্পদের চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ ঘটছে। সব দেশের পুঁজিবাদী সরকারের মতো ভারতেও সরকার প্রচার করে, জাতীয় আয় বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে, কিন্তু দেখা যায় এর সাথে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এর সুফল দেশের ৯০ ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। ১০ শতাংশ ধনকুবেরের জন্যই তা নির্দিষ্ট।
টাকা না থাকলে যে কেনা যায় না, তা বুঝতে অর্থনীতির পণ্ডিত হতে হয় না। ফলে সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা কমে গেলে পণ্য বিক্রি কমে। এ জন্যে বাজার সংকট দেখা দেয়। বাজার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে বিশ্বের সাথে সাথে ভারতেও। অর্থনীতির এই সংকটের মধ্যেও পুঁজিপতিরা কী করে এত মুনাফা বাড়াচ্ছে? ৯০-এর দশক থেকে সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া এবং অর্থনীতির উদারিকরণের নামে বহুজাতিক কোম্পানিকে লুটে নেওয়ার ঢালাও সুযোগ করে দিয়েছিল সরকার। তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার আর্থিক সংস্কারের নামে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্য উদারতা দেখিয়েছিল, বতর্মান বিজেপি সরকার তারই পথ বেয়ে বৃহৎ পুঁজিমালিকদের মুনাফার দিকে তাকিয়েই সমস্ত নীতি নির্ধারণ করছে, সংসদে তা নিয়ে আইন পর্যন্ত তৈরি করছে। পুঁজিপতিদের জন্য ত্রাণ প্যাকেজ দিচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব করছে। একচেটিয়া মালিকরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দু’হাতে লুঠতে দেশের সাধারণ মানুষের উপর শোষণের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। করোনা অতিমারি পরিস্থিতিতে এইভাবে তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে।
অন্য দিকে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? ভারতে মাথা পিছু খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমছে, বাড়ছে অপুষ্টি, অর্ধাহার, নানা রোগ। উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছে না চাষি, ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। বেকারি তীব্র আকার ধারণ করেছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োগ নেই বললেই চলে। অসংগঠিত শ্রমিকদের অত্যন্ত কম মজুরিতে বেগার খাটানো হচ্ছে। ছাঁটাই, লে-অফ, লকআউট– নানা আক্রমণে বিপন্ন হচ্ছে শ্রমিকের বেঁচে থাকার অধিকার।
অসাম্যের এই ভয়াবহ চিত্র যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকেই টলিয়ে দিচ্ছে তা পুঁজিবাদের রক্ষক এবং সেবকরাও যে বোঝেন না তা নয়। তাই তারা মাঝে মাঝে দারিদ্র দূরীকরণের কথা বলে নানা পরিকল্পনা ছকে। কখনও রাষ্ট্রসংঘ মোটা মোটা ফাইল ভরে দারিদ্র দূরীকরণের কর্মসূচি তৈরি করে। কখনও ভারত সরকার তেন্ডুলেকর কমিটি, রঙ্গরাজন কমিটির মতো কমিটি গঠন করে। কিন্তু দারিদ্র দূর হয় না, হওয়ার কথাও নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই এই ভয়াবহ দারিদ্রের কারণ। তা বজায় রেখে দারিদ্র দূর করা অলীক স্বপ্ন। ফলে এশিয়া-আফ্রিকার পরিচিত দরিদ্র দেশ নয়, দারিদ্রের কবলে পড়েছে উন্নত বলে পরিচিত বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলির জনগণও।
এই বৈষম্য থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি ঘোরাতে উন্নয়নের আশ্বাসবাণী সব ক্ষমতালোভী দলই দিয়ে থাকে, কিন্তু উন্নয়ন ঘটে শুধু শিল্পপতি-পুঁজিপতি-একচেটিয়া পুঁজির মালিকদেরই। সাধারণ মানুষের জীবনের করুণ চিত্র বদলায় না। যদিও জনগণকে ভোলাতে সব দলই বলে, উপরতলার সমৃদ্ধি নিচের তলায় চুঁইয়ে নামবে। কিন্তু তা যে কত বড় মিথ্যা তা কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ হয়ে যায়। তখন একটা রাস্তাই খোলা থাকে এই দলগুলির নেতাদের কাছে– যে কোনও প্রকারে হোক দরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো। কিন্তু সংখ্যাতত্ত্বের এই কারচুপি খোদ বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের তৈরি করা এক একটি রিপোর্টেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গেও বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা
তথ্যে প্রকাশ, পশ্চিমবঙ্গের তিন ভাগের এক ভাগ পরিবার অপুষ্টির শিকার। এখনও ৬১ শতাংশের বেশি পরিবার রান্নার গ্যাসের বদলে কাঠ ও কয়লা ব্যবহার করেন। ১০০টি-র মধ্যে ৪৭টি পরিবারের পাকা বাড়ি নেই। শতকরা ৩২টি পরিবারের বাড়িতে নিজস্ব শৌচাগার নেই। এই সমস্ত মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকার জন্য রাজ্যের ২১.৪ শতাংশ মানুষকে নীতি আয়োগ দরিদ্র বলে চিহ্নিত করেছে। রাজ্য সরকার অবশ্য এই রিপোর্ট নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। কারণ তাদের বলার কিছু নেই। |