‘আচ্ছা বলুন তো রাজ্যে মানুষের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলি কী?’ প্রশ্নটি শোনামাত্র যে কেউ বলবেন, ‘কেন মশাই আপনি কি এ রাজ্যে থাকেন না?’ তারপরই গড়গড় করে বলে যাবেন, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, শিক্ষার দফরফা হয়ে যাওয়া, চিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি অজস্র সমস্যা মানুষের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে৷
প্রশ্নটি উঠে এসেছে সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জী ও বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর সভা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের তোলপাড় করা ঘিরে৷ দুজনেই একে অন্যের এলাকায় গিয়ে সভা করেছেন৷ অভিষেক করেছেন কাঁথিতে গিয়ে এবং শুভেন্দু করেছেন ডায়মন্ড হারবারে৷ সভার অনেক আগে থেকেই সংবাদমাধ্যম সেই খবরের ধারাভাষ্য চালিয়ে গেছে৷ উভয়েরই মুখে অনেক আগে থেকে ‘লড়কে লেঙ্গে’ ভাব৷ পরস্পরকে দোষারোপ৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন কড়া নাড়ছে৷ তার জন্যই উভয়ের এই তরজা, যা মিনিটে মিনিটে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে নিউজ চ্যানেলগুলি৷
সভায় তাঁরা কে কী বললেন? প্রথমে দেখা যাক সরকারি দলের অন্যতম শীর্ষব্যক্তি অভিষেক ব্যানার্জী কী বললেন৷ যা বললেন তা শুনে বহু তৃণমূল সমর্থকও বলছেন, ‘এ তো টিভির রিয়েলিটি শো সাজানো বত্তৃণতা৷ বাস্তবের ছোঁয়ামাত্র নেই৷’ কেন উঠছে এ কথা? কলকাতা থেকে কাঁথি যাওয়ার পথে বড় রাস্তার ধারে একটি গরিব পাড়ায় হঠাৎ অভিষেকের কনভয় থেমে যায় এবং তিনি নেমে পড়ে মানুষের সাথে কথা বলেন৷ মানুষ তাঁদের অভিযোগের কথা নেতাকে জানান৷ সেই বিষয়টিই অভিষেক সভায় তুলে ধরেন৷ বলেন, ‘কাউকে না বলে একটা গ্রামে গেলাম৷ অনেকগুলি তফসিলি জাতি, উপজাতিভুক্ত পরিবার সেখানে থাকে৷ কী করুণ অবস্থা বলছে প্রধান, উপপ্রধানকে জানিয়ে লাভ হয়নি৷ অথচ তাঁরা এমন কিছু চাইছেন না, যা তাঁদের চাওয়ার অধিকার নেই৷’ সভায় যারা তুমুল হাততালি দিয়ে নেতার পিঠ চাপড়েছেন তাঁরা পর্যন্ত জানেন এটা সত্যিই রিয়েলিটি শো৷ সাজানো কথা৷ ভোটের সময় নেতাদের এ সব বলতে হয়৷ এখন ‘মিডিয়ার ফুটেজ’ কথাটা নেতারা যেমন বোঝেন, তেমনই তাঁদের পিছনে ঘোরা জনতাও বোঝে৷ তাই মানুষ বলছে, জনগণের সুখ–দুঃখ নিয়ে কতখানি চিন্তিত তা দেখাতেই গরিব পাড়ায় কনভয় দাঁড় করানো৷ গ্রামবাসীদের অভিযোগের কথাগুলিই সভায় তুলে ধরা৷ এত কিছু মনে পড়ছে কি সামনে ভোট বলে? ক্যামেরার বন্দোবস্ত ছাড়া কি তিনি থামতেন, কথা শুনতেন? আরও প্রশ্ন তাঁদের, রাজ্যে এমন গরিব পাড়া কি ওই একটিই আছে? বাকি অজস্র মানুষ যে গরিবির অন্ধকারে তলিয়ে রয়েছেন, সে–কথা কি এই নেতা জানেন না? তাঁদের সরকারের বয়স তো প্রায় ১২ হতে চলল৷ কই তাঁদের দুঃখের কথা, বঞ্চনার কথা তো এর আগে কখনও এই নেতার মুখে শোনা যায়নি৷ কখনও কোনও গরিব মানুষের দরজায় তো তাঁকে এমন করে যেতে দেখা যায়নি প্রধান,উপপ্রধানের বিরুদ্ধে প্রতিটি পঞ্চায়েতে ঠিক এমনই দলবাজি, স্বজনপোষণ, চুরি, দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের হয়রানির অজস্র অভিযোগ কি প্রতিদিন ভুক্তভোগীরা করছেন না? তা হলে তো তাঁদের সবাইকে পদত্যাগ করতে হয়৷ কই, কোথাও তো কোনও প্রধান, উপপ্রধানকে পদত্যাগ করতে হয়নি তা হলে হঠাৎ অভিষেক তাঁর সভা থেকে এই দুজনকে পদত্যাগ করতে বললেন কেন? আসলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক মুখে অভিষেকের হাতে–গরম বক্তৃতার উপকরণ সংগ্রহের জন্য কোথাকার কে এক প্রধান এবং উপপ্রধানকে বলি দেওয়া হল এবং সব কিছু ছাপিয়ে এই নেতা কত কড়া প্রশাসক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কত বড় যোদ্ধা উপস্থিত জনতার কাছে তা প্রমাণ করা গেল৷ এটাকেই মানুষ বলছেন টিভির রিয়েলিটি শো৷
অভিষেক ব্যানার্জীর বক্তৃতার আর বাকি অংশেও কোথাও পাওয়া গেল না রাজ্য জুড়ে দুর্নীতির যে বিরাট স্রোত বইছে তাকে আটকানোর কথা, দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্ণিত করে তাদের শাস্তি দেওয়ার কথা৷ শোনা গেল না চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার কথা, ফসল বিক্রি করতে গিয়ে চাষিরা যে মারাত্মক দুর্নীতির কবলে পড়ছে তার সুরাহার কথা৷ রাজ্যে ভয়াবহ বেকারত্ব দূর করতে রাজ্য সরকার কোনও জরুরি ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না তেমন কোনও কথাই বত্তৃণতায় উঠে এল না৷ শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের দ্রুতগতিতে অধঃপাতে যাওয়া কী ভাবে রোখা যাবে, সে কথাও তাঁর বত্তৃণতাতে ছিল না৷
বক্তৃতার বাকি অংশটি জুড়ে ছিল শুধুই জনগণের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু শুকনো কথা এবং বিরোধী দল এবং নেতার প্রতি অন্তঃসারশূন্য হুঙ্কার৷ এমনকি যে বিরোধী দলের নেতার সম্পর্কে তিনি এত হুঙ্কার ছাড়লেন সেই বিজেপির যে মারাত্মক ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, আধিপত্যবাদী রাজনীতি, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে বিজেপি–আরএসএসের লোক বসিয়ে সেগুলিকে কুক্ষিগত করা এবং তার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, ইতিহাসকে বিকৃত করা–-এ–সবের বিরুদ্ধে কোনও কিছুই তাঁর বক্তৃতায় এল না৷ এল না কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের সহযোগিতায় জনগণের উপর একচেটিয়া পুঁজির স্টিমরোলার চালানোর কথাও৷ জনস্বার্থ রক্ষা করতে এই রাজনীতির মোকাবিলায় তাঁরা আদৌ কোনও কর্মসূচি নিচ্ছেন কি না, সে রকম কোনও কথাই শোনা গেল না৷ স্বাভাবিক ভাবেই কিছু দলীয় স্তাবক ছাড়া বাকি শ্রোতারা ফিরলেন মুখ শুকনো করে৷
ডায়মন্ড হারবারে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁর বক্তৃতায় কী বললেন? বললেন ‘বিজয় উৎসবের’ কথা৷ তিনি নাকি ডায়মন্ড হারবারে এ মাসেই বিজয় উৎসব করবেন৷ কীসের বিজয় উৎসব? না, তিনি বলেছেন এখনই তা বলবেন না৷ তবে উপস্থিত শ্রোতাদের তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি৷ এই বিরোধী নেতা বেশ কিছু দিন ধরেই ‘ডেডলাইনের’ কথা বলে চলেছেন৷ পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল সরকারের ডেডলাইন৷ কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি যে রাজ্যে রাজ্যে কিংবা কেন্দ্রে বিজেপি যে সরকার চালাচ্ছে তার সাথে তৃণমূল সরকারের আদৌ কোনও ফারাক আছে কি না৷ তাঁদের হাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ইডি, সিবিআই থাকা সত্ত্বেও কেন সারদা এবং নারদা দুর্নীতির তদন্ত মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল, সে প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি৷ সিবিআই–ইডি তৃণমূল সরকারের পাহাড়–প্রমাণ দুর্নীতির যে তদন্ত করছে, কেন হাইকোর্টের বিচারপতি তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন, কেন তিনি বলছেন, আদৌ এই তদন্ত কোনও দিন শেষ হবে কি না জানি না, এই প্রশ্নের উত্তরও তাঁর বক্তৃতায় পাওয়া যায়নি৷ অর্থাৎ তৃণমূল নেতার মতোই বিজেপি নেতার বক্তৃতাও জনস্বার্থের সাথে সম্পর্কশূন্য শুকনো কথার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই নয়৷
বাস্তবে এইসব দলের সভাগুলি পরস্পরের প্রতি কু–কথা বর্ষণেরই মঞ্চ হয়ে উঠেছে৷ এমনি করেই ভোটবাজ এই সব দলগুলি জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়গুলিকেই সামনে এনে জোর গলায় প্রচার চালায় যাতে মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি সামনে আসতে না পারে৷ এই ভাবেই তারা মানুষকে ভোট রাজনীতিতে ফাঁসিয়ে দেয়৷ পুঁজিপতি শ্রেণির মালিকানায় চলা সংবাদমাধ্যমও প্রচুর হইচই তুলে এটাকেই আসল লড়াই বলে দেখায়৷ মানুষকে বোঝায় আন্দোলন কোরো না, এই তরজার থেকে একজনকে বেছে ভোট দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷ এ ভাবেই তারা মানুষকে তাদের জীবনের মূল সমস্যাগুলোর আসল কারণটাকে জানতে দেয় না, আড়াল করে রাখে৷ মানুষও খবরের কাগজে, নিউজ চ্যানেলে অবিরাম এই প্রচার শুনে দেখে এই রাজনীতিতেই ফেঁসে যায়৷ ফেঁসে গিয়ে একবার এই দলকে ভোট দেয়, তারপর হতাশ হয়ে আবার ওই দলকে ভোট দেয়৷ তারপর মনে মনে বলতে থাকে, সবাই সমান, এ দেশে কিছু হবে না৷
অথচ এই সাধারণ মানুষের হাতেই রয়েছে এই দলগুলির প্রতারণার রাজনীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষমতা৷ তাঁরা যদি এই সব ভোটবাজ দলগুলির নেতাদের বক্তৃতা শুনে রাজনীতি বুঝতে চান তবে এই প্রতারণার রাজনীতি চলতেই থাকবে৷ ভোটরাজনীতির এই যাঁতাকল থেকে তাঁরা কোনও দিনই বেরোতে পারবেন না৷ এই চক্কর থেকে বেরোতে হলে রাজনীতিটা নিজেদের বুঝতে হবে৷ তার জন্য মাথা ঘামাতে হবে৷ এ সব প্রশ্ণের উত্তর খুঁজতে হবে–যে দলই ক্ষমতায় বসছে কেন তাঁরা সবাই এমন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে? কেন ভোটের সময় যে সব প্রতিশ্রুতি এই সব নেতারা দেন, ভোটে জিতে ঠিক তার উল্টো কাজ করেন? গণতন্ত্রের যে বড়াই এই সব দলগুলি করে কেন তাতে জনগণের মতামতের কোনও মূল্য নেই? দুর্নীতিগ্রস্ত এই সব দলগুলির একজনকে সরিয়ে আর একজনকে বসালে শাসনের–শোষণের কোনও পার্থক্য কি ঘটবে? জনগণের প্রকৃত দাবি কীসে আদায় হবে? কেন দেশের কোটি কোটি মানুষের মাথার উপর যখন সামান্য একটু ছাউনি মিলছে না, তখন এক শ্রেণির মানুষের ঘরে টাকার পাহাড় জমছে?
মানুষের এই দুরবস্থা দূর করার সত্যিই কি কোনও রাস্তা আছে, থাকলে সেই রাস্তাট কী? এই সব প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর পাওয়ার মধ্যেই রয়েছে জনস্বার্থ রক্ষার গ্যারান্টি৷ কিন্তু ভোটবাজ, ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত এই সব নেতাদের বক্তৃতার থেকে এই সব প্রশ্ণের কোনওটির উত্তর মিলবে না৷ তার জন্য খোঁজ করতে হবে বিপ্লবী রাজনীতির৷