দুর্নীতিতে কে কম যায়!

টিভির উত্তেজিত অ্যাঙ্কর আর খবরের কাগজের পাতা জোড়া স্টোরিতে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি আর গরুপাচার কাণ্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের দুই মহারথীর গ্রেপ্তার, টাকার স্তূপের ছবি নিয়েই এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তরজার আসর সরগরম। এমন কিছুদিন খুব হইচই চালিয়ে মিডিয়া দৌড়বে অন্য হাতেগরম উত্তেজনার পিছনে। দুর্নীতিগ্রস্তদের কী শাস্তি হল, দুর্নীতির মূল উৎপাটনের কী হল, ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের ক্ষতিপূরণের কী ব্যবস্থা হল– সবই চাপা পড়ে যাবে। মাঝে মাঝে ভোট প্রচারে নেতা-নেত্রীরা একে অপরের দিকে কালি ছুঁড়তে গিয়ে নিজেদের দুর্নীতির পাল্টা জবাবে টেনে আনবেন অন্যের দুর্নীতির কথা। ‘ও আমার থেকে বেশি দুর্নীতি করেছে’ এটা বোঝাতে পারলেই সব কাদা ধুয়ে যায়! কিন্তু জনগণ কি ভুলতে পারে তাদের কষ্টার্জিত পয়সা নিয়ে এই লুঠের কারবার! তাই দেখে নেওয়া যাক কোন দলের শাসনে দুর্নীতির সাগরে ভাসা হিমশৈলের উপরের মাপটা কেমন!

বিজেপি

সর্বোচ্চ ঘুষখোর প্রশাসনঃ ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’-এর সমীক্ষা বলছে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ‘এশিয়ার সর্বোচ্চ ঘুষখোর’ প্রশাসনের তকমা পেয়েছে ভারত। সরকারি দপ্তর থেকে কোনও সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন, ন্যায্য সুবিধা, স্কুল-কলেজে ভর্তি ইত্যাদির ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষের টাকা তৈরি রেখে দরখাস্ত করতে হয়। এই প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। (দ্য ওয়্যার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০) বিজেপি শাসনে সরকারি দপ্তরে আরটিআই করে তথ্য জানতে পারা বিরল হয়ে উঠছে। ফলে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা কমছে। (ওই)

কর্ণাটকের খনি কেলেঙ্কারিঃ জমি এবং খনি কেলেঙ্কারির একাধিক ঘটনায় বিজেপি নেতা ইয়েদুরাপ্পা ও রেড্ডি ভাইরা অভিযুক্ত। ৩৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। বিজেপির শীর্ষ স্তরের নেতা, পুলিশ, আমলা, বিচারক, সরকারি আইনজীবীদের ঘুষ দিয়ে বেআইনি কারবার ফাঁদার অভিযোগ একাধিক মামলায় আছে। কিন্তু সিবিআই নাকি কিছুতেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না! তাই ‘প্রমাণ নেই’ বলে ফাইল ধামাচাপা!

আসামের লুইস বার্জারজলপ্রকল্প কেলেঙ্কারিঃ এক সময় অমিত শাহের নামে প্রচারিত লিফলেটে আসামের জলপ্রকল্প সংক্রান্ত লুইস বার্জার কেলেঙ্কারির জন্য বিজেপি যাঁকে অভিযুক্ত করেছিল, সেই হিমন্ত বিশ্বশর্মা এখন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর আসন আলো করছেন। অভিযোগ গোয়াতে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তে সিবিআই এগোলেও আসামে পৌঁছলেই তাদের পা যেন আর চলতে চায় না!

ব্যাপম কেলেঙ্কারিঃ মধ্যপ্রদেশে সরকারি চাকরি ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত দুর্নীতিতে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ঘুষের কারবার হয়েছে। এর প্রতিবাদ করে এবং খোঁজ নিতে গিয়ে একাধিক সাংবাদিক সহ প্রায় ৩৩ জন মানুষের রহস্যমৃত্যু ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, বিজেপির শিবরাজ সিং চৌহান। কোনও শাস্তি হয়নি।

ছত্তিশগড়ের রেশন কেলেঙ্কারিঃ ৩৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ২০১৩ থেকে ২০১৬-র মধ্যে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ সিং বাঘেলার আমলে। কোথায় সিবিআই?

এছাড়াও রাজস্থানে বিজেপি সরকারের আমলে ৪৫ হাজার কোটি টাকার খনি দুর্নীতি, ওই রাজ্যেই বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর নামে ঢোলপুর প্যালেস দখলের অভিযোগ, ললিত মোদি, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সি, বিজয় মালিয়া ইত্যাদি ব্যাঙ্ক লুঠেরা ও জালিয়াতদের সাথে বিজেপির নেতাদের দহরম মহরম কেউ অস্বীকার করতে পারে না। গুজরাট স্টেট পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনে দুর্নীতি, আদানি পাওয়ারকে বাড়তি ৫০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতি, রাফাল দুর্নীতি, বালকো দুর্নীতি, ডাল দুর্নীতিতে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গায়েব, ন্যানো কারখানার জমি নিয়ে গুজরাটে ৩৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি– এরকম অজস্র আছে।

সম্প্রতি অযোধ্যার রামমন্দিরের জমি নিয়েও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সেই বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে নারদা, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতারা বিজেপিতে নাম লেখানোর পর সিবিআই ইডির চোখে কেমন করে অদৃশ্য হয়ে আছেন সেটাও বেশ রহস্যের। নোট বাতিলের পর গুজরাট থেকে বিজেপির প্রাক্তন এমএলএ শচীন ওঝা ওই রাজ্যের সমবায় ব্যাঙ্ক ও বিজেপির উঁচুতলার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কোনও পদক্ষেপ নিয়েছেন?

কংগ্রেস

১৯৪৭ এ স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যত দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার সম্মিলিত পরিমাণ ৪ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। (জি নিউজ ২২.০৮.২০১৯) এর মধ্যে বহুল প্রচারিত কেলেঙ্কারিগুলি হল– ১৯৪৮-এ জওহরলাল নেহেরুর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে সেনাবাহিনীর জিপ কেলেঙ্কারি। ১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে ঘুষ কেলেঙ্কারি, ১৯৭৬-এ তেল কেলেঙ্কারি, যাতে ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী যৌথভাবে অভিযুক্ত। ১৯৯৭ এ রাজীব গান্ধীর আমলে বোফর্স কেলেঙ্কারি, ২০০৭-এ আইএনএক্স মিডিয়া কেলেঙ্কারি, ২০০৮-এ টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, ২০০৯-এ সত্যম কেলেঙ্কারি, ২০১০-এ কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি, ২০১২-এ কয়লা কেলেঙ্কারি, হেলিকপ্টার ও টেট্রা ট্রাক কেলেঙ্কারি, আদর্শ আবাসন কেলেঙ্কারি, শেয়ার কেলেঙ্কারি ইত্যাদি। এখন ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কতটা কাজ করছে আর বাস্তব দুর্নীতি কতটা তা সময়ই বলতে পারবে।

তৃণমূল কংগ্রেস

চিটফান্ড ও নারদা কেলেঙ্কারিঃ ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর রোজ ভ্যালি ইত্যাদি নানা চিটফান্ডও তদন্তের মুখে পড়েছে। কিছু চিটফান্ড কর্তা ও তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রথমে সিআইডি, পরে সিবিআই তদন্ত চলছে। কিন্তু দ্রুত বিচার শেষ করে দোষীদের শাস্তি বা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা যেন সকলে ভুলেই গেছে। নারদ সংস্থার চালানো স্টিং অপারেশনে তৃণমূলের একধিক সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার টাকা নিতে গিয়ে ছবিতে ধরা পড়েছেন। এর তদন্তটাই যেন রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর আগে ত্রিফলা আলো কেলেঙ্কারির কোনও কিনারা হয়নি। সম্প্রতি নিয়োগ দুর্নীতির বিস্ফোরণ ঘটেছে। বালি, কয়লা ও গরু পাচার কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই চলছে। এরও পরিণতি কী হবে, সত্যিই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়ে দোষীরা শাস্তি পাবে, নাকি এই তদন্তও আসলে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার হাতিয়ারে পরিণত হবে? এটাই মানুষের প্রশ্ন।

সিপিএম

সিপিএমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বের শেষ বেলায় ‘মালায়লা মনোরমা’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তাঁরা শুনছেন না। তাঁর কথায়, সিপিএম নেতারা স্থানীয় রাজা হয়ে উঠেছেন (দ্য হিন্দু, ২৫.০২.২০১১)। ওই বছর ডিসেম্বরে কৃষ্ণনগরে দলের সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ব্যাপক দুর্নীতির জন্যই আমরা হেরেছি (হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯.১২.২০১১)।

সিপিএম আমলে বহু আলোচিত ১৯৮০-র দশকে বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠদের মালিকানায় চলা বেঙ্গল ল্যাম্প কোম্পানির উচ্চপদস্থ ছিলেন তাঁর পুত্র। সেই কোম্পানি সরকারের থেকে অন্যায়ভাবে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল। এই তথ্য ফাইল থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী মানতে না চাওয়ায় তাঁকে মন্ত্রিসভা ত্যাগ করতে হয়।

এ ছাড়া ওয়াকফ কেলেঙ্কারি, ট্রেজারি কেলেঙ্কারি, পার্সোনাল লেজার অ্যাকাউন্ট কেলেঙ্কারি এগুলি তো আছেই। সারদা কেলেঙ্কারির বীজ পোতা হয়েছিল সিপিএম নেতাদের হাত ধরেই। সঞ্চয়িতা চিটফান্ড কেলেঙ্কারির কথাও সহজে ভোলার নয়। এছাড়াও সে সময় শাসকদলের স্থানীয় নেতারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌরসী পাট্টা গেড়ে থাকা নেতারা কী পরিমাণ দুর্নীতি করেছেন, তা আজও বহু মানুষের অভিজ্ঞতায় জ্বলজ্বল করছে। পঞ্চায়েতগুলি এই সময়েই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যা আজ আরও ব্যাপক রূপ নিচ্ছে। শাসকদলগুলি সকলেই তাই বিরোধী আসনে থাকার সময় অন্যের দিকে আঙুল তোলে, বলে ওর থেকে আমাদের দুর্নীতি কম ছিল।