দুয়ারে সরকারের পরে এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নতুন চমক ‘দুয়ারে ডাক্তার’। অভিনব পদক্ষেপ! ভোটের আগে মানুষ যাতে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করে সেই উদ্দেশ্যেই কি এই ব্যবস্থা? কারণ সরকার তো জানে আমাদের দেশের মানুষ তার হাতের কাছে একজন ডাক্তারের সংস্পর্শটুকু পেলেই ধন্য হয়ে যায়। এমনকি ভিডিও কল মারফত পেলেও তারা কৃতার্থ বোধ করে। যে কারণে আজ সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি থেকে কেবলমাত্র ভিডিও কলের মাধ্যমে ডাক্তারের সংস্পর্শে মানুষকে নিয়ে আসা হচ্ছে। সরাসরি ডাক্তারের পরিষেবা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা সত্ত্বেও তো মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছে। আর ঘরের দুয়ারে মেডিকেল কলেজের বড় ডাক্তার বাবুর দর্শন মিললে মানুষ যারপরনাই আনন্দিত হবে সে কথা ভেবেই কি সরকারের এই দুরভিসন্ধি?
এত দিন ধরে আমাদের দেশে এবং সারা পৃথিবী জুড়েই স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ত্রিস্তরীয় একটি পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। একেবারে নিচে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিভিন্ন রোগের স্ক্রিনিং করা, রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া এবং ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন রোগ ও মহামারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি পরিষেবাগুলি দেওয়া হয়। এর পরবর্তী স্তরে রোগীর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যম ও টার্শিয়ারি স্তরে রেফারের ব্যবস্থা করা হয়। কাগজে কলমে এসব থাকলেও বাস্তবে এই স্তরগুলির প্রতিটা স্তরেই পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত লোকবলের বিরাট অভাব।
একটা উদাহরণ দিলেই তা বোঝা যাবে। জনসংখ্যার নিরিখে একেবারে গ্রাম স্তরে প্রতি ৫ হাজার এবং পার্বত্য ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় প্রতি ৩ হাজার মানুষ পিছু একটি করে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা। বর্তমানে গড়ে ৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার মানুষ পিছু রয়েছে একটি, অর্থাৎ বতর্মান পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার নিরিখে ধরলে শহর এবং গ্রাম মিলে ২০ হাজারের উপরে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা ছিল।
শহরাঞ্চলে যে সংখ্যাটা মাত্র ২০০। গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ১০৩৫৭ মাত্র। শহর এবং গ্রাম মিলে ৪৬৬১টি নতুন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরির কথা থাকলেও এখনো পযর্ন্ত তার পরিকাঠামো সম্পূর্ণ রূপে তৈরিই করা হয়নি। অথচ ভোটের চমক দেওয়ার জন্য এর মধ্যে বেশ কিছু উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালুও করে দেওয়া হয়েছে। নতুন স্বাস্থ্যকর্মী না দিয়ে পার্শ্ববর্তী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়েই এই কাজ চালু করা হচ্ছে। ফলে যেখানে পুরনো উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি এমনিতেই অর্ধেক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে কোনওক্রমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতো নতুন এই ব্যবস্থায় পুরনো এবং নতুন উভয়ের পরিষেবারই কি গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটানো হবে? এর ঠিক উপরের স্তর অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকার কথা প্রায় ৩৫০০টি, রয়েছে গ্রামের ক্ষেত্রে মাত্র ৯০৮টি এবং শহরের ক্ষেত্রে ৪৪৮ অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৩৫৬ অর্থাৎ ঘাটতি রয়েছে ৬৪ শতাংশ। এর উপরের স্তরে গ্রামীণ হাসপাতাল থাকার কথা কমপক্ষে ১ হাজারটি রয়েছে মাত্র ৩৪৮ অর্থাৎ এক্ষেত্রেও ঘাটতি ৬৫ শতাংশ। ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট্যান্ডার্ড ধরলে ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ৫০ শতাংশেরও কম। মহকুমা এবং জেলা হাসপাতাল থেকে রোগীদের যে সব পরিষেবা পাওয়ার কথা তাতে সমস্ত রকম বিশেষজ্ঞ বিভাগগুলি সেখানে থাকার কথা। সেখানে সমস্ত বড় বড় অপারেশনও হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই ক্ষেত্রেও পরিকাঠামো এবং প্রশিক্ষিত লোকবলের বিপুল অভাবে পরিষেবা আজ ভেঙে পড়ার মুখে।
ঠিক একই ভাবে আজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরের প্রতিটা স্তরের পরিষেবাই আজ ভেঙ্গে পড়েছে। বাধ্য হয়ে মানুষ প্রাথমিক ও মধ্যম স্তরে না গিয়ে খুব সাধারণ রোগের জন্যেও মেডিকেল কলেজগুলোতে যেতে বাধ্য হন। ফলে মেডিকেল কলেজগুলোর ভঙ্গুর পরিকাঠামো এবং লোকবল ঘাটতিজনিত কারণে চলতে থাকা অব্যবস্থা আরও প্রকট হতে থাকে। উপচে পড়া ভিড়ে চাপা পড়ে যায় রোগীর সাধারণ পরিষেবাটুকু। এই স্তরে চিকিৎসক শিক্ষকদের একাধারে রোগীর চাপ সামলাতে হয় এবং মেডিকেল, নার্সিং, প্যারামেডিকেল ছাত্রদের পড়ানোর কাজও করতে হয়। ফলে রোগীর পরিষেবা যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি করে বিঘ্নিত হয় ছাত্রদের ক্লিনিকাল ট্রেনিংয়ের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ফলে সমাজ ভবিষ্যতে কীভাবে উন্নত মানের চিকিৎসক পাবে সে প্রশ্নটাই আজ চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে।
এই সংকট কাটানোর ব্যবস্থা না করে ভোটের আগে চটকদার রাজনৈতিক ঝোঁকে সরকার মেডিকেল কলেজগুলো থেকে ডাক্তারদের বাড়ি বাড়ি পাঠাচ্ছে। নাম হয়েছে ‘দুয়ারে ডাক্তার’। অথচ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত কোনও পরিষেবারই উন্নতির ব্যবস্থা সরকার করল না। ডাক্তাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেমন অপারেশন করতে পারবেন না বা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন না। এমনকি একদিন যাওয়ার বিনিময়ে মানুষের রোগ সেরে ওঠা তো দুর অস্ত, রোগ নির্ণয়ও সম্ভব হবে না। অন্যদিকে তিনি উক্ত সময়ে মেডিকেল কলেজে থাকলে যতগুলি অপারেশন বা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারতেন, মানুষ সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবেন। ছাত্রদের ট্রেনিংয়ের কাজ যতটা তদারকি করতে পারতেন তাও আজ বিশবাঁও জলে চলে যাবে না কি?
ফলে স্তরে স্তরে পরিকাঠামো এবং লোকবল না বাড়িয়ে দুয়ারে ডাক্তার পাঠানোর মতো তুঘলকি পদক্ষেপ কার্যত মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে আরও বেশি বঞ্চিত করবে। সমাজ বঞ্চিত হবে ভবিষ্যতের দক্ষ চিকিৎসক পাওয়া থেকেও। প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা ভোটের আগে রাজনৈতিক চমক হতে পারে কিন্তু মানুষের চিকিৎসা পরিষেবার কোনও সুরাহা হবে না। উপরন্তু যতটুকু সরকারি পরিষেবা আজও টিকে রয়েছে, তাও ধ্বংস হবে। আমরা এই ধরনের তুঘলকি পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছে চিকিৎসক সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম এবং তাঁরা স্তরে স্তরে ঘাটতি পরিকাঠামো সহ লোকবলের ঘাটতি পূরণের দাবি জানিয়েছেন।