৩ ফেব্রুয়ারি অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির উদ্যোগে দিল্লির গালিব অডিটোরিয়ামে বিজেপি সরকারের চরম জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী জনমত ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং একটি বিকল্প জনমুখী প্রণয়নের উদ্দেশ্যে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। উপস্থিত ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬০০-র বেশি শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষাকম¹।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নবতিপর অধ্যাপক ইরফান হাবিব অসুস্থ থাকায় অনলাইনে সম্মেলনের উদ্বোধন করে বলেন, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালু করার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত। প্রত্যেক দেশেরই নিজের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন, ভারতের ক্ষেত্রেও তা সত্য। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা কমিশন ভারতের অতীতকালের একটি বিকৃত চিত্র উপহার দিয়েছে। ভারতের বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় জ্ঞানধারা নামে যা তারা করেছে, তা মনুস্মৃতি ভিত্তিক। তিনি বলেন, জ্ঞানের কোনও জাতীয় সীমানা থাকতে পারে না। বিজেপি সরকার ইতিহাসের পুনর্গঠন করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
হিমাচল প্রদেশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ফুরকান কামার বলেন, স্বচ্ছতার অভাব এবং বেসরকারি ক্ষেত্রকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এই শিক্ষানীতির বড় সমস্যা। দিল্লির জেএনইউ-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা শিক্ষার ব্যবসায়ীকরণের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, এই শিক্ষানীতি নিপীড়িত শ্রেণির মানুষকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। সরকার শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব থেকে সরে আসতে চাইছে। প্রাক্তন উপাচার্য সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলেন, একটা বিশেষ মতাদর্শকে ভিত্তি করে তৈরি এই শিক্ষানীতি ইতিহাসকে বদলে দিচ্ছে। ডারউইন তত্ত্ব ও পর্যায় সারণীর মতো পরীক্ষিত বিজ্ঞানের তত্ত্বকে বাতিল করছে।
প্রাক্তন উপাচার্য এল জহর নেশান শিক্ষা সহ মানুষের চিন্তাধারা, অভ্যাস, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রাকে একটা ছাঁচে ঢালার চেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর কথায়, মহাকাব্যকে ইতিহাস হিসাবে গণ্য করা চলে না। অথচ ঠিক সেই কাজটাই গত ২২ জানুয়ারি সরকারি উদ্যোগে করা হল। ভারতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির বিজ্ঞানী অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের উদ্বেগ– ‘একটি জাতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হারালে সে দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। মন্ত্রীরা দাবি করছেন এ দেশই গণতন্ত্রের জন্মদাত্রী। অথচ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে এ দেশ বিশ্বে পিছনের সারিতে। কেবল ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রভিত্তিক শিক্ষাকে মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষা হিসাবে তুলে ধরে এই শিক্ষানীতি ছাত্র-যুবদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পূর্ণভাবে ধবংস করছে। বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ এই শিক্ষানীতির সবথেকে বিপজ্জনক দিক’।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বিপজ্জনক জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির নেতৃত্বে দেশ জুড়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা তুলে ধরেন। এই আন্দোলনের চাপে কর্ণাটক সরকার ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রত্যাহার করে ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করছে। তিনি বলেন, সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি দেশজুড়ে শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-পড়ুয়াদের মতামতের ভিত্তিতে জনমুখী, গণতান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়ন করছে। আন্দোলনের মাধ্যমে এই বিকল্প শিক্ষানীতি কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করা হবে। সম্মেলনের সভাপতি গুজরাট সাহিত্য পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রকাশ এন শাহ তাঁর সংক্ষিপ্ত বত্তৃতায় বলেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা হত ‘সারেন্ডার নট’। আমাদের আন্দোলনও তেমন দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন সঞ্চালনা করেন কমিটির সর্বভারতীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রাজাশেখর।
দ্বিতীয় অধিবেশনে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স, উচ্চশিক্ষা ও স্কুলশিক্ষা নিয়ে তিনটি ‘প্যানেল ডিসকাসন’ হয়। এই অধিবেশন সঞ্চালনা করেন সর্বভারতীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমল সাঁই।
প্রতিনিধি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রকাশ এন শাহ। সম্পাদক সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন এবং কয়েকজন প্রতিনিধি তার উপর আলোচনা করেন। সবশেষে প্রকাশ এন শাহকে সভাপতি ও অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্করকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি গঠিত হয়।