আপনি বাজারে গিয়ে চক্কর কেটেই যাচ্ছেন, দামের ছ্যাঁকায় আঁৎকে উঠছেন। পাশে দেখলেন বিমলবাবু কিংবা পাশের পাড়ার ফারুক শেখ সকলেরই এক দশা। সংসার চলবে কী করে, এই চিন্তায় কত রাত নিদ্রাহীন কাটছে আপনার। এই সময় যদি খবর পান– দেশে দারিদ্র কমে গেছে! কেমন লাগবে শুনে? বেশ মন ভালো করা খবর না! ঠিক এমনটাই জানা গেল সম্প্রতি। আমি আপনি সংসার চালাতে যত নাজেহালই হই না কেন– সম্প্রতি প্রকাশিত দারিদ্র সংক্রান্ত রিপোর্টে বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে ভারতে চরম দারিদ্র একেবারে তলানিতে নেমে গেছে! ভাবছেন, কখন কমল, বুঝতেই পারলাম না তো! পরশুরামের গল্পের কবিরাজ মশাই বলতেন, ‘হয়, হয়, জানতি পারো না’! এও কি তেমন কিছু!
বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে ২০২২-২০২৩ অর্থবর্ষে ভারতে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এক লাফে ১৭ কোটি কমে গেছে। ফলে ভারতে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এক ধাক্কায় ১৬.২ শতাংশ থেকে নেমে ২.৩ শতাংশ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে সাফল্যের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মোদি সরকার ও গোদি মিডিয়া। কী এই দারিদ্রের সংজ্ঞা? বিশ্বব্যাঙ্কের ভাষায় যারা মাথা পিছু দৈনিক ৩ ডলারের নিচে খরচের ক্ষমতা রাখেন তাঁরা চরম দারিদ্র সীমায় আছেন। তার ওপরে ৩.৬৫ ডলার পর্যন্ত নিম্ন-মধ্য আয়ের দরিদ্র, ৬.৮৫ ডলার পর্যন্ত উচ্চ-মধ্য দরিদ্র স্তরে আছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ২০২৪-এর অক্টোবরে বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছিল, ২০২১-২২-এর খরচের নিরিখে ভারতের জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ আছে নিম্ন-মধ্য আয়ের দারিদ্র সীমার নিচে এবং ১২.৯ শতাংশ আছে চরম দারিদ্র সীমার নিচে। দেখা যাচ্ছে বিগত সময়ে সরকারের সমস্ত প্রচার সত্তে্বও এক বছরে দারিদ্র কমেছে খুব বেশি হলে ২ শতাংশ, সেখানে এক মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে এক ধাক্কায় ১০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র সীমার ওপরে চলে গেল কোন ম্যাজিকে?
এদিকে আপনি দেখছেন বাজারে থরে থরে জিনিস সাজানো, কিন্তু সব দোকানিই বলছেন ব্যবসা নেই। একটার পর একটা সমীক্ষা বলছে গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরেও সাবান-শ্যাম্পু, বিস্কুট, তেল ইত্যাদি জিনিস কেনার পরিমাণ কমছে। বেশিরভাগ পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে পুরো চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, ছেলে-মেয়েকে ভাল স্কুল-কলেজে পড়াতে গেলে ধার করা ছাড়া রাস্তা নেই, পরিবারের সকলকে নিয়ে মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই ঠিকমতো বানানোর মতো পয়সা পকেটে নেই। এ রকম কত নেই-এর তালিকা যে আপনি নিজেই করতে পারবেন তার শেষ নেই। যাঁরা নিজেদের মধ্যবিত্ত বলেন, তাঁরাও এই কাজগুলো ঠিক মতো করে উঠতে পারছেন না।
সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে চাকরিজীবীদের সবচেয়ে রোজগেরে অংশ অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের গড় বেতন ১৩,৭৭৭ টাকা। আর যাদের সংসারের সবচেয়ে বেশি দায় সামলাতে হয় সেই ৫৫ বছর বয়সি মানুষের গড় বেতন মাসে ১০,৩৬৫ টাকা (কেন্দ্রীয় স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেনটেশন মন্ত্রকের তথ্যের ভিত্তিতে পে-টিএম সংস্থার প্রতিবেদন,৬.০১.২৫)। মনে রাখতে হবে যে কোনও গড় হিসাবের মতোই আম্বানি সাহেবের কোম্পানির সিইও-র বেতন থেকে শুরু করে হরিপদ কেরানি কিংবা গিগ শ্রমিকের আয় এতে একসাথে ধরা আছে। আরও ভাবুন, একটা পরিবারে কতজন রোজগার করেন? বেশিরভাগ পরিবারের ক্ষেত্রেই তা একজন বা দু’জন! এবার বলুন, আপনার জানা কটি পরিবার এমনকি আপনি নিজেও বিশ্বব্যাঙ্কেরই দারিদ্র সূচকে কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন? অতল গহ্বরের মুখে নয় কি?
তাহলে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এমন উল্লেখযোগ্য হারে কমল কী করে? আসলে এর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে হিসাবের পদ্ধতির মধ্যেই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্রের মাপাকাঠিটা ঠিক কেমন? তারা হিসাব করে ডলারে। বাজারে ১ ডলারের দাম এখন ৮৫ টাকা হলেও এই হিসাবের ক্ষেত্রে তার মূল্য তা নয়। এখানে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) ধরে হিসাব করা হয়। অর্থাৎ কোনও একটা জিনিস, ধরুন গম, আমেরিকায় ১ ডলারে কিনলে যতটা পাওয়া যাবে ভারতে তার দাম বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাবে (২০১৭-র নিরিখে) ২০.১৫ টাকা। তাহলে এই হিসাবে ৩ ডলার মানে দাঁড়ায় ৬০.৪৫ টাকা। অর্থাৎ ৪ জনের একটা পরিবারের আয় দাঁড়ায় ৭২৫৪ টাকা। নিম্ন মধ্য আয়ের দরিদ্র পরিবারের আয় প্রায় ৯ হাজার টাকা। উচ্চ মধ্য আয়ের দরিদ্র পরিবারে তা সাড়ে ১৬ হাজার টাকার কাছাকাছি।
এবার ভাবুন এই টাকা দিয়ে কী হয়? ফলে এর থেকে সামান্য একটু আয় বাড়লেই আপনার পেট নাই ভরুক, ওদের রিপোর্টে দারিদ্র কমার কথা লিখতে অসুবিধা হয় না। কীভাবে এই হিসাব কষা হল! এই হিসাব করা হয় ভারত সরকারের ‘হাউজহোল্ড কনজাম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’-র ভিত্তিতে। যে সমীক্ষার মান নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক অর্থনীতি গবেষক। নমুনার সংখ্যা, নমুনা নেওয়ার পদ্ধতি, বিজ্ঞানসম্মতভাবে নমুনা সংগ্রহের এলাকা ঠিক করা ইত্যাদিতে বহু ঘাটতি তাঁরা দেখিয়েছেন। এই রিপোর্টে ধরে নেওয়া হয়েছে ৮০ কোটি ভারতবাসী বিনামূল্যে রেশনে চাল-গম পান। ফলে চাল, আটা, ডাল কিনতে তাঁদের খরচ হয় না। তাঁরা বাস্তবে কী পান তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। অতএব বলে দেওয়া হল এদের খরচের শক্তি বেড়েছে। এই পদ্ধতি এমন যে, কোনও পরিবারে সমীক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন– দুধ কিনেছেন? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে সেই পরিবার মাসে একদিন কিনেছে না প্রতিদিন কিনেছে তা আলাদা প্রশ্ন করা হবে না। এর পর আর কোনও দিন দুধ না কিনলেও এই সমীক্ষায় নথিভুক্ত হয়ে গেল যে ওই পরিবার সারা মাস ধরেই দুধ কেনে। যা সত্য নয়। চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিপুল হারে কমার পিছনে এই সব কায়দা কাজ করেছে বলেই গবেষকরা অভিযোগ তুলেছেন।
তা ছাড়া দারিদ্র কি শুধু খাদ্যের জন্য ব্যয় দিয়ে মাপা যায়? যে পরিবারে খাদ্য আছে, তারাও চিকিৎসা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, পরিবহণ ইত্যাদি পরিষেবার খরচ বৃদ্ধিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাঙ্ক ২০২২-এর অক্টোবরে যে পদ্ধতিতে দারিদ্র মাপার কাজ করেছিল ২০২৫-এর এপ্রিলে তা হঠাৎ পরিবর্তন করে দিয়েছে। তাতেই দেখা যাচ্ছে দারিদ্র এক ধাক্কায় নেমে গেছে। এ যেন গোল দেওয়ার জন্য গোলপোস্টকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া!
দেখা যাচ্ছে দারিদ্র মাপার জন্য জীবনের সমস্ত প্রয়োজনকে ধরে সূচকগুলি নিলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। অর্থনীতি সংক্রান্ত সমীক্ষা সংস্থা সিএমআইই-ও বলেছে বিস্তৃত প্রেক্ষিতে না বিচার করে এ ভাবে দারিদ্র মাপা যায় না। এই নিরিখে বাস্তবে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান দাঁড়িয়েছে ১০৫-এ। শিশুদের অপুষ্টি, বাড়হীন শিশু, সঠিক পুষ্টির অভাবে কম উচ্চতার শিশুর সংখ্যায় ভারত এগিয়ে আছে অনেক। ভারতে বেকারত্বের হার সরকারি হিসাবে এখন ৭.৯ শতাংশ।
বাস্তব পরিস্থিতি হল দারিদ্রের জ্বালায় ১০০ দিনের কাজে মজুরি বাজার মূল্যের থেকে কম হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ আজও এর ওপরেই নির্ভরশীল। লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট অর্থাৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যার যত সংখ্যা কিছু কাজ করেন, গত এপ্রিলে তা ছিল ৫৫.৬ শতাংশ। মানে একটা বিরাট অংশের কর্মক্ষম মানুষ কোনও কাজই পান না। এর পরেও আছে রোজগারহীন শ্রমদান। সরকারি হিসাবই বলছে মহিলাদের রোজগারহীন শ্রমদানের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। এদের সংখ্যাটাও কিন্তু কর্মরতদের হিসাবে ধরা আছে। তাহলে সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাবও রইল, মোদি সরকারের কৃতিত্বও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল! কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের রোজগার, তাদের জীবনের মানের উন্নয়ন, রোজগার, সন্তানের ভবিষ্যৎ, সকলকে নিয়ে সুস্থভাবে বাঁচা এ সবের কী হবে?
দেশের মানুষের খরচ বাড়লেই দারিদ্র কমে গেছে এই তত্ত্বও কি গ্রহণযোগ্য? এক একটা পরিবার কী পরিস্থিতিতে খরচ করতে বাধ্য হয়, কী ভাবে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তা কি সরকারের অজানা?
২০১৪-র জুনের হিসাবে ভারতে পারিবারিক ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪২.৯ শতাংশ (ফিনান্সিয়াল টাইমস, ১৫.০৪.২০২৫)। এই ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির যথেষ্ট রোজগার থাকুক আর নাই থাকুক, তারা ঋণ করেই চিকিৎসা, শিক্ষা, সহ নানা পরিষেবা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এর সঙ্গে নানা প্রচারের ফাঁদে ফেলে মানুষের ঋণভিত্তিক কেনাকাটা সরকার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বহু পরিবার ঋণের জালে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সরকার দেখাতে পারছে কেনাকাটা বাড়ছে, পরিষেবার গ্রাহক বাড়ছে। তারা বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে নিজেদের কৃতিত্ব দেখিয়ে পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিকাঠামোর জন্য আরও ঋণ নিয়ে আসতে পারছে। আর দুনিয়াকে দেখাচ্ছে কত উন্নয়নই না এ দেশের মানুষের হচ্ছে! এই হল পুঁজিবাদী উন্নয়নের আসল রূপ। যাতে ভুললে সর্বনাশ সাধারণ মানুষেরই।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ১৩ – ১৯ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত