দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং দলিত রমণীদের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন৷ যারা অস্পৃশ্য বলে উচ্চবর্ণের কাছে অপাংক্তেয়, ঘৃণার পাত্র, তাঁদের শুধু স্পর্শ করেছেন তাই নয়, একেবারে পা ধুইয়ে দিয়ে প্রমাণ দিচ্ছেন তিনি কত বড় দলিতপ্রেমী৷ মিডিয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি ভারতবাসী সম্প্রতি এহেন দৃশ্য চাক্ষুষ করেছেন৷ তার পরেই সাড়ম্বরে প্রচার করে বলা হচ্ছে, গান্ধীর পরে মোদিই পারলো দলিতদের সত্যিই আপনজন হয়ে উঠতে৷ তিনি অস্পৃশ্যদের সত্যিই আপনজন হয়ে উঠেছেন কি না তা নিয়ে প্রচারের আলোর ঝলকানিকে সরিয়ে রেখে দেখা যাক মোদির নেতৃত্বে বিগত বছরগুলিতে বিজেপি সরকার বাস্তবে সামাজিকভাবে তাঁদের কতটা সম্মান বাড়িয়েছে, কতটা উন্নতি করেছে দলিতদের?
সংবাদে প্রকাশ, সমাজের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর পেশা মানুষের মল বহন করার কাজটি এ দেশে আজও প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ খিদের জ্বালা মেটাতে করতে বাধ্য হন৷ ২০১৩ সালে এই চরম অমানবিক প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়ে এই অসহায় মানুষদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়৷ ২০১২–১৩ সালের বাজেটে এই খাতে ৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও ‘দলিতপ্রেমী’ মোদি সরকার এই মানুষদের জন্য সেই বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে একটি পয়সাও ব্যয় করেনি৷ এইভাবেই মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করেছে কোনও পয়সা খরচ না করেই৷ পরিহাসের বিষয়, এই সরকারই স্বচ্ছ ভারত গডে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করে জনগণের উপর ‘স্বচ্ছ ভারত সেস’ চাপিয়েছে, আর মোদির ছবি সহ স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেছে ৫৩০ কোটি টাকা৷ মলবাহকরা সকলেই অনগ্রসর শ্রেণির এবং এদের প্রায় ৯৪ শতাংশ মহিলা৷ মোদির দলিত মহিলার পা ধুইয়ে দেওয়ার খবর শুনে সাফাইকর্মী আন্দোলনের এক নেতার মন্তব্য, ‘‘শুধু ২০১৮–য় নর্দমা ও সেপটিক ট্যাঙ্ক সাফ করতে গিয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়ছে৷ উনি চুপ করে ছিলেন৷ এখন পা ধুইয়ে দিচ্ছেন৷’’
শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে এ দেশে একের পর এক বর্ণ বৈষম্য এবং জাত–পাত কে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনা ঘটে গেছে৷ রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা কি আমরা এত তাড়তাড়ি ভুলে যাব? গো–রক্ষার নামে শুধু মুসলিমদের নয়, গুজরাটে মোদির সাঙ্গোপাঙ্গরা দলিত মানুষদের হত্যা করেছিল৷ ২০১৫ সালের মে মাসে রাজস্থানের নাগাউর জেলায় আরএসএস–এর মদতে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত হত্যা, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরে দাঙ্গা (২০১৬, ২০১৮ তে) অথবা গত বছরে যোধপুরে বা তামিলনাড়ুতে হরিজন হত্যার ঘটনা, ভীমা কোরেগাঁও–এর ঘটনা সহ সমস্ত দলিত নির্যাতনের ঘটনাতেই বিজেপি এবং আরএসএস অভিযুক্ত৷
এবার তথ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর সরকারি তথ্য কী বলছে? মোদির এই দলিত প্রেমের মুখোশ খুলে দিয়েছে এনসিআরবি–র তথ্য৷ দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরগুলিতে নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর অত্যাচার ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ২০১৫ সালে দলিতদের ওপর অপরাধের সংখ্যা ৩৮৬৭০টি৷ আর ২০১৬ সালে এ ধরনের অপরাধ ঘটেছে আরও বেশি ৪০৮০১টি৷ সবচেয়ে বেশি অত্যাচার ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে (২৬ শতাংশ)৷ তারপর যথাক্রমে বিহার (১৪ শতাংশ) এবং রাজস্থান (১২.৬ শতাংশ) এর স্থান৷
এই যেখানে দেশের অবস্থা, সেখানে হঠাৎ করে মোদির এই দলিত–পদসেবার ভেক ধরার কারণ কী? আসলে ভোট বড় বালাই৷ মোদি যতই হিন্দুত্বের জিগির তুলুন না কেন, গোটা দেশের দলিত অনগ্রসর জনজাতির মানুষের জন্য না করেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, না দিয়েছেন সামাজিক সুরক্ষা৷ উল্টেবিজেপি–আরএসএস উগ্র বর্ণহিন্দুদের ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করতে মুসলিম বিদ্বেষ এর সাথে সাথে দলিত বিদ্বেষকেও মদত দিয়েছেন৷ আর এখন লোকসভা নির্বাচনের মুখে এসে দলিত প্রেমী সেজে তাদের মন পাওয়ার চেষ্টা করছেন ভোট বৈতরণী পার হওয়ার আশায়৷