১ জুলাই থেকে ভারতের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় শুরু হয়েছে নতুন তিন আইনের শাসন। ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসির বদলে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা (বিএনএস), ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসির বদলে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) ও এভিডেন্স অ্যাক্টের বদলে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (বিএসএ)। গত বছর ১১ আগস্ট সংসদে বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে আইনমন্ত্রীর বদলে প্রথা বহির্ভূতভাবে বিল পেশ করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গত ডিসেম্বরে ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে, প্রায় বিরোধীশূন্য সংসদে পাশ করানো হয়েছিল তিনটি বিল, যা ২৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর আইন হয়ে যায়। বিস্তারিত মতামত গ্রহণ, আলোচনা-পর্যালোচনার তোয়াক্কা না করেই অত্যন্ত দ্রুততায় বিল তৈরি থেকে আইন পাশ করিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আইনের একটি সংশোধনেই যেখানে পর্যাপ্ত তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন থাকে, সেখানে দেশের আইনের সম্পূর্ণ কাঠামোটির বদল ঘটাতে জনসাধারণ এবং আইনবিদ সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার চেষ্টাই করল না কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার অবশ্য পরামর্শদাতা হিসাবে বিজেপি এবং আরএসএস-এর সদস্য বা ঘনিষ্ঠ কিছুজনের নাম তুলে ধরছে। ফলে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া এই তিনটি আইন কোনও ভাবেই গণতান্ত্রিক আইন কাঠামো দিতে পারে কিনা প্রশ্ন উঠছে।
একটা পরাধীন দেশের আইন আর একটা স্বাধীন দেশের আইন এক হবে না, এই ভাবনাটাই স্বাভাবিক। ব্রিটিশ ভারতের আইন ছিল ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্যই, প্রতিবাদী জনসাধারণের উপর দমনপীড়ন, অত্যাচারের জন্যই। একটা স্বাধীন দেশের আইন জনস্বার্থবাহী হবে, ন্যায় বিচারের পরিপূরক হবে, নাগরিকদের এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। ফলে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, দেশের নতুন আইন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হবে, নতুন আইন আধুনিক ভারতের উপযোগী হবে, তখন শুনতে বেশ ভাল লাগে। কিন্তু মনে রাখতে হবে একটি আইন নির্যাতনমূলক ও জনবিরোধী কি না তা আইন তৈরির সময় দিয়ে নির্ধারিত হয় না, সেই আইন জনগণের পক্ষে কল্যাণকর কিনা তা দিয়ে নির্ধারিত হয়। নতুন ফৌজদারি আইনের ধারা-উপধারা বিচার করে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই আইন ঔপনিবেশিকতার নৃশংসতাকেও অতিক্রম করে গেছে। উপনিবেশের চিহ্ন মোছার নামে পুরনো আইনের কিছু শব্দের অদল-বদল করে, ধারাগুলি আগে-পিছে করে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে একই রেখে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য পরিবর্তনগুলির ছত্রে ছত্রে নাগরিক-স্বাধীনতা হরণের ষড়যন্ত্র নগ্ন হয়ে উঠেছে। নতুন আইনের কয়েকটি মাত্র ধারা পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ভারতীয় ন্যায়সংহিতা
পুরনো ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ধারা, যা দেশদ্রোহ আইন (সিডিশন) হিসেবে পরিচিত, গত বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট সেই আইন প্রয়োগের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এই ঔপনিবেশিক আইন বাতিলও করেছে। কিন্তু তার বদলে যা নিয়ে আসা হয়েছে, তাকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রফেসর মোহন গোপাল সঠিকভাবেই ‘সিডিশন প্লাস’, অর্থাৎ দেশদ্রোহ আইনেরও বাড়া বলে চিহ্নিত করেছেন। ন্যায়সংহিতার ১৫২ ধারা বলছে, কোনও কাজ, লেখা, বক্তব্য বা সংকেতের মাধ্যমে যদি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘নাশকতামূলক কাজ’, ‘ভারতের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করবে এমন কাজ’ করার জন্য উত্তেজিত করা হয় বা উত্তেজিত করার চেষ্টা হয় তা হলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আইনের মোড়ক বদলেছে কিন্তু ভেতরের মাল-মশলা কিছু বদলায়নি বরং আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এই সমস্ত বিষয়গুলির সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আইনে নেই। ফলে সরকার বিরোধী বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও বক্তব্যকেই এই আইনের আওতায় ফেলা যাবে।
মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, ন্যায় সংহিতার ১১৩ ধারা দানবীয় ইউএপিএ-র ১৫ নম্বর ধারার হুবহু নকল। বিশেষ আইন ইউএপিএ থাকছে, কিন্তু ইউএপিএ ধারায় মামলা করতে হলে তদন্তকারী পুলিশের বাইরে সাধারণ প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চ পদাধিকারীদের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ন্যায় সংহিতার এই ধারায় কার্যত ইউএপিএ-তেই মামলা হবে, পুলিশ সুপারের অনুমতি নিয়ে থানার এসআই এই মামলা করতে পারবে। এই ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে কার্যত অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে, তিনি নির্দোষ। এই ধারায় ‘সন্ত্রাসবাদী কাজ’-এর সংজ্ঞা যে ভাবে দেওয়া হয়েছে তাতে যে কোনও সাধারণ বক্তব্য, যা বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করবে, তাকেও অনায়াসে সন্ত্রাসবাদী কাজের আওতায় ফেলে দেওয়া যাবে। দানবীয় ইউএপিএ আইনেও সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এত বিস্তৃত নয়।
ন্যায়সংহিতার ১১১ ধারায় ‘সংগঠিত অপরাধ’-এর মতো বিশেষ ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সাধারণ দণ্ডবিধিতে। সংগঠিত অপরাধকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে প্রায় যে কোনও সরকারবিরোধী কণ্ঠস্বরকেই এই ধারার আওতায় ফেলে দেওয়া যায়। এমনকি যার বিরুদ্ধে কোনও কোর্টে একাধিক চার্জশিট জমা পড়বে, তাকেই ‘ধারাবাহিক বেআইনি কাজকর্ম’-এর সঙ্গে যুক্ত বলে গণ্য করা যাবে অর্থাৎ দোষী প্রমাণ করার দরকার নেই, একাধিক অভিযোগ আনলেই হল। এর সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
ন্যায়সংহিতার ১১২ ধারায় ‘পেটি অর্গানাইজড ক্রাইম’-এর সংজ্ঞায় বিভিন্ন অপরাধের তালিকা দেওয়ার পর শেষ লাইনে বলা হয়েছে ‘অথবা এ রকম যে কোনও অপরাধমূলক কাজকর্মকে পেটি অর্গানাইজড ক্রাইম বলা হবে’। অর্থাৎ পুলিশ ইচ্ছামতো এই লাইনটিকে ব্যবহার করতে পারে। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রসংঘ বলেছিল, আইন যত অস্পষ্ট হবে, সেই আইনের প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা তত বাড়বে। এই আইনে পুলিশের হাতে অবাধ যথেচ্ছাচারের হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছে।
সারা পৃথিবীতেই প্রতিবাদ জানানোর পদ্ধতি হিসাবে অনশন মান্যতা পায়। ন্যায় সংহিতার ২২৬ ধারায় সরকারের নিষেধ না মেনে কোনও বিষয়ের প্রতিবাদে অনশন করলেও হতে পারে জেল। কারণ আইনে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি যদি যে কোনও সরকারি কর্মচারীকে তাঁর কাজে বাধা দেওয়ার জন্য বা তাঁকে দিয়ে কোনও কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তা হলে তার এক বছরের জেল অথবা জরিমানা অথবা দুটিই হবে। অর্থাৎ অনশনকে আত্মহত্যার চেষ্টা বলে দেখিয়ে প্রতিবাদীকে জেলে পোরা হবে।
ন্যায়সংহিতার ১৯৭(১ডি) ধারায় মিথ্যা তথ্য প্রকাশ ও পরিবেশনের শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা কে বিচার করবে? সকলেই জানে, সেটা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করবে। সরকারের বহুবিধ ব্যর্থতা, প্রতারণা, কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে কিছু বললেই তা হবে মিথ্যা আর তার জন্য শাস্তি হবে। সংবিধানের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে স্বীকৃত নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার বলে নতুন আইনে আর কিছু থাকবে না।
ন্যায়সংহিতার ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, জেল জরিমানার বদলে বিনা পারিশ্রমিকে ‘কমিউনিটি সার্ভিস’-এর সাজা প্রচলন প্রগতিশীল পদক্ষেপ। অথচ কোনটা কমিউনিটি সার্ভিস সেটা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। পুরনো দিনের জমিদারদের খিদমত খাটার মতো সরকারের সেবা করাই হয়তো কমিউনিটি সার্ভিস বলে গণ্য হবে।
আইনের বহু ক্ষেত্রেই সাজাপ্রাপ্তের নির্জন কারাবাস বা সলিটারি কনফাইনমেন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ন্যায় সংহিতার ১১ নম্বর ধারা তার একটি। সুপ্রিম কোর্টের ১৯৭৯ সালের সুবিখ্যাত সুনীল বাত্রা মামলার রায় উপেক্ষা করেই এই বন্দোবস্ত। ব্রিটিশ আইনে যতটুকু রক্ষাকবচ ছিল, এ ক্ষেত্রে তা-ও থাকবে না।
সামগ্রিকভাবে নতুন দণ্ডবিধির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধি। ৩৩টি ক্ষেত্রে কারাবাসের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন মানে হয়েছে আমৃত্যু কারাবাস। ১৪ বছর কারাবাসের পর বন্দির আচার-আচরণ বিবেচনা করে রেমিশন এবং মুক্তির যে সুযোগ ছিল, এ ক্ষেত্রে তা-ও কেড়ে নেওয়া হল। সাজাপ্রাপ্তের আমৃত্যু ঠিকানা হল জেলখানা। জেলখানাকে সংশোধনাগার হিসেবে দেখার যে উন্নত চিন্তা বুর্জোয়া আইন কাঠামোতেই এসেছিল তা এখানে অর্থহীন করে দেওয়া হয়েছে।
৮৩টি ক্ষেত্রে জরিমানাও বিপুল বাড়ানো হয়েছে, বৃদ্ধির হার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১০০০ শতাংশ। মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বদলে আগের ১১টি ক্ষেত্র থেকে বাড়িয়ে ১৫টি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক উন্নত দেশগুলোতে ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হচ্ছে অথচ ভারতের নতুন আইনে মৃত্যুদণ্ড বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা
পুরনো আইনে ছিল অভিযুক্ত একবার জেল হেফাজতে গেলে আর পুলিশ হেফাজতে ফিরিয়ে আনা যায় না। সিবিআই বনাম অনুপম জে কুলকার্নি (১৯৯২-’৯৩) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলেছিল, তদন্তের প্রয়োজনে পুনরায় অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে বিচারবিভাগীয় হেফাজতেই করতে হবে। কিন্তু সুরক্ষা সংহিতার ১৮৭ ধারায় বলা হয়েছে জেল হেফাজত থেকে অভিযুক্তকে আবার পুলিশ হেফাজতে ফিরিয়ে আনা যাবে। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক ৯০ দিন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতের নিদান রয়েছে। এতে হেফাজতে অত্যাচারের নৃশংসতা বাড়বে, এ আশঙ্কা অমূলক নয়। সুরক্ষা সংহিতার ১৭২ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির না করিয়েই ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নাগরিককে আটকে রাখার (ডিটেনশন) সুযোগ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কোনও নাগরিক পুলিশের আদেশ না শুনলে পুলিশ তাকে আটকে রাখতে পারবে। বাস্তবে পুলিশকে যা ইচ্ছে তাই করার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হল এই ধারায়।
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় আছে, যেখানে বলা হয়েছে কোনও সভ্য সমাজে হাতকড়ার ব্যবহার চলতে পারে না। অথচ সুরক্ষা সংহিতার ৪৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, পুলিশ চাইলে গ্রেফতার করার সময় হাতকড়া পরাতে পারে। মনে রাখতে হবে, অভিযুক্ত মানেই সে অপরাধী নয়। যে কোনও অভিযুক্তকে যখন হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন জনসমক্ষে তার সম্মানহানি হয়। বিচারের পর যখন যদি সে নির্দোষ প্রমাণিতও হয়, তবুও এ অসম্মানের দাগ তার গা থেকে মোছে না। এটা মানবাধিকার ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
গ্রেফতারের সময় থেকেই অভিযুক্তের সরকারি আইনি সহায়তা পাওয়ার কথা। নতুন আইনে তা-ও থাকবে না। একমাত্র বিচার চলাকালীন অভিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ করতে না পারলে সরকারি সহায়তা মিলবে।
ললিতা কুমারী বনাম স্টেট অফ উত্তবপ্রদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী পুলিশ এফআইআর করতে বাধ্য ছিল। সুরক্ষা সংহিতার ১৭৩(৩) ধারা অনুযায়ী প্রাথমিক তদন্তের আগে পুলিশ চাইলে এফআইআর না-ও করতে পারে। যে অপরাধ নিয়ে অভিযোগ, তা যদি তিন থেকে সাত বছরের সাজাযোগ্য হয়, তবে পুলিশ আগে অনুসন্ধান করবে, সন্তুষ্ট হলে তবে এফআইআর করবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি ক্ষমতাশালী এবং অভিযোগকারী অসহায় হলে এমনিতেই পুলিশকে দিয়ে এফআইআর করানো কঠিন, আর এখন পুলিশের এফআইআর করার কোনও বাধ্যবাধকতাই রইল না। এতদিন পুলিশ যে সব বেআইনি কাজ করত, সেগুলোরই সব আইনি স্বীকৃতি নতুন আইন-পুস্তকের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে।
সুরক্ষা সংহিতার ৫৩ ধারায় পুলিশ হেফাজতে থাকা বন্দির প্রতি ৪৮ ঘণ্টা অন্তর বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা (পুরনো আইনে ছিল) বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। একবার দেখার পর ডাক্তার মনে করলে তবেই ফের পরীক্ষা হবে। পুলিশ লক আপে থাকা বন্দির কাছে পুলিশের মর্জি ছাড়া ডাক্তার পৌঁছবে কী করে? সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করে এই আইনে রেজিস্টারে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ অফিসারের নাম নথিভুক্তির ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। অ্যারেস্ট মেমোতে সময় ও স্থান লেখার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়েছে। এতদিন সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন মেনে অভিযুক্তর পরিবারকে জানাতে হত, গ্রেফতারের পর অভিযুক্তকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে। সেটাও নতুন আইনে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বিচার প্রক্রিয়া না প্রহসন, বুঝে ওঠা দায়।
সুরক্ষা সংহিতার ৩৪৯ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের মনে হলে, কোনও ঘটনায় ‘তদন্তের স্বার্থে’ যে কোনও নাগরিককে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ভয়েস স্যাম্পল দিতে বাধ্য করতে পারবে, সেই নাগরিক কোনও মামলায় অভিযুক্ত না হলেও। নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। নাগরিক মাত্রই হবেন সন্দেহভাজন।
সুরক্ষা সংহিতার ৩৫৬ ধারায় বিচারপর্বে অভিযুক্ত ‘পলাতক’ হলেও, তার অনুপস্থিতিতেই বিচার হয়ে যাবে। এমনকি সাজা ঘোষণাও হয়ে যাবে। পুলিশ চাইলে কাউকে আদালতে হাজির না করেই, এমনকি তাকে না জানিয়েই ‘পলাতক’ বলে দিতে পারে, সে সম্ভাবনাও থেকেই যাচ্ছে। একেই বোধহয় বলে ‘একুশে আইন’।
অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অন্যতম উপায় সাক্ষীদের জেরার সুযোগ। সুরক্ষা সংহিতার ৩৩০ ধারায় সেই সুযোগও সংকুচিত করা হয়েছে। তদন্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট নেওয়া হলেও, বিচার পর্বে সেই বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য দিতে নাও ডাকা হতে পারে। সেটা নির্ভর করবে বিচারকের মর্জির উপর।
বিচারের ঢের আগে তদন্ত পর্বেই বন্দি অভিযুক্ত সম্পর্কে পুলিশ ছবি সহ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারবে। নাগরিকের মানবিক মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়ার এই আইন রয়েছে সুরক্ষা সংহিতার ৩৭ ধারায়। বিচারে অভিযোগ ভুল প্রমাণ হলে তার সামাজিক সম্মান কি ফিরে পাওয়া যাবে? এ ক্ষেত্রে আইনে কিন্তু পুলিশের কোনও শাস্তির সংস্থান নেই।
সুরক্ষা সংহিতার ১০৭ ধারা অনুসারে তদন্ত চলা অবস্থাতেই কারও কোনও সম্পত্তি ‘অপরাধের সূত্রে প্রাপ্ত’ বলে পুলিশের মনে হলে, কোর্টের অনুমতি নিয়ে তা বাজেয়াপ্ত করা যাবে। জেলাশাসকের মাধ্যমে বিলিবণ্টনও করে ফেলা যাবে। ভেবে দেখুন, এটা ঘটবে তদন্ত চলাকালীন, বিচারে অপরাধ প্রমাণের আগেই। এমনকি বিচার শেষ হওয়ার আগে (সুরক্ষা সংহিতা ৪৯৭) বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির ছবি তুলে ১৫ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশও দিতে পারেন ম্যাজিস্ট্রেট। বিচার নয়, যথেচ্ছ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে।
পুলিশ অভিযোগ না নিলে, এতদিন অভিযোগ জানানোর অন্যতম বিকল্প পথ ছিল ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের শরণাপন্ন হওয়া। অভিযোগকারী ও তার তরফে সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে ম্যাজিস্ট্রেট মামলা গ্রহণ করতেন। নতুন সুরক্ষা সংহিতার ১৭৩(৩), ১৭৫(৩,৪), ২২৩ ধারায় রয়েছে, অভিযোগ যদি পুলিশ বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে হয়, তা হলে ম্যাজিস্ট্রেটকে আগে শুনতে হবে অভিযুক্ত ও তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের বক্তব্য। সেই ব্যাখ্যা শোনার পর ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে মামলা অগ্রাহ্য করতে পারেন।
নতুন আইনে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তল্লাশি ও বাজেয়াপ্ত করার, কোনও জমায়েত নিষিদ্ধ করার জন্য ‘সশস্ত্র বাহিনী’-কে আদেশ দেওয়ার অধিকার ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কোনও প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তিনি বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন। জমি সংক্রান্ত মামলায় হস্তক্ষেপ করে, ব্যক্তির জমির অধিকারও কেড়ে নিতে পারবেন।
পুরনো ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৬(এ) ধারায় লম্বা সময় বিচারাধীন বন্দি কেউ সম্ভাব্য সাজার মেয়াদের অর্ধেক পেরোলেই জামিন পাওয়ার (ডিফল্ট বেল) অধিকারী হতেন। বিলম্বিত বিচারে নাগরিকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়া প্রতিরোধের উপায় ছিল এটা। নতুন সুরক্ষা সংহিতার ৪৭৯ ধারায় এখন থেকে শুধুমাত্র প্রথমবার অভিযুক্ত বন্দিরাই এই সুযোগ পাবে। ফলে বিচার শেষের আগেই বন্দি হয়ে থাকার মেয়াদ আরও লম্বা হবে। অসংখ্য বিচারাধীন বন্দির ভিড়ে উপচে পড়বে জেলখানা। আইনে বলছে, যাবজ্জীবন কারাবাস বা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এমন মামলায় বিচারাধীন বন্দি ডিফল্ট বেল চাইতেই পারবেন না। অথচ হয়তো বিচার শেষে দেখা যাবে সেই বন্দি নিরপরাধ। ততদিনে জেলেই কেটে গিয়েছে ১৪-১৫ বছর। বিনা দোষে লম্বা জেল খাটতে হলেও, নাগরিকের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ কিন্তু আইনে নেই। অক্ষরধাম কেসে সুপ্রিম কোর্ট, বিনা দোষে এক বছর জেলে থাকার জন্য এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছিল। নতুন আইনে সেই ক্ষতিপূরণ মাত্র ১ হাজার টাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এতে ভুয়ো গ্রেফতারির সংখ্যা অসংখ্য বেড়ে যাবে। বাড়বে জনসাধারণের হয়রানি।
এটা স্পষ্ট যে, নতুন আইনের নাম ন্যায় সংহিতা, সুরক্ষা সংহিতা হলেও সামাজিক ন্যায় ও নাগরিক সুরক্ষা থেকে আইনগুলি শত যোজন দূরে। সমস্ত আইন জুড়ে শুধুমাত্র প্রশাসনিক আদেশের কথাই আছে। ফৌজদারি আইনে যে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সাজা দেওয়ার কথা ছিল, নতুন ধারা নতুন শব্দ নতুন বাক্যবন্ধের মধ্য দিয়ে তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মানবাধিকার ধ্বংস করার সিংহদুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম
এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর পরিবর্তে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়মের মূল পরিবর্তনটা হল, প্রযুক্তি ব্যবহারে বিপুল গুরুত্ব আরোপ। পুলিশ মোবাইলে জবানবন্দি নেবে এবং ভিডিও-তে কথোপকথন রেকর্ড করবে, সেটাই তথ্য প্রমাণ হিসেবে বিচার প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত ধরতে হবে। সাক্ষীর বয়ান বা অভিযুক্তের জবানবন্দির ভিডিও পুলিশ কোথায় তুলছে, কী ভাবে তুলছে জানা যাবে না। কারণ সেখানে আইনজীবী উপস্থিত না-ও থাকতে পারেন। দূর থেকে বন্দুকের নল তাক করে সাক্ষীর বয়ান বা অভিযুক্তের জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে কি না, এর মীমাংসা করার কোনও উপায় নেই।
সাক্ষ্য অধিনিয়মে ভার্চুয়াল ট্রায়াল ও ভিডিও মাধ্যমে বিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে অভিযুক্তের আইনজীবী ভাল করে জেরাই করতে পারবেন না সাক্ষীদের। মনে রাখতে হবে, জেরা পর্বে সাক্ষীর শরীরী ভাষাও গুরুত্বপূর্ণ, যা বোঝার কোনও উপায় থাকবে না।
সাক্ষী ও তদন্তকারী অফিসারদের আদালতে সশরীরে উপস্থিত হতে না হলে অনেকখানি সময় বেঁচে যাবে– এই যুক্তি কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কারণ বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়া এত দীর্ঘ যে, বিনা বিচারে অসংখ্য মানুষকে বন্দি থাকতে হয়। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। কোর্টগুলির অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো, বিচারপতির অভাব ও সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতায় বিচার বিলম্বিত হয়। ২০০৫ সালে দ্রুত বিচারের জন্য ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু করা হয়েছিল। সেই ফার্স্ট ট্র্যাককোর্টগুলোর অবস্থা কী? শীর্ষ থেকে নিম্ন সব আদালতেই বিচারকের অভাবে ভুগছে। দ্রুত বিচার সরকারের উদ্দেশ্য হলে সেখানে পরিকাঠামো উন্নত করা, অর্থ বরাদ্দ করা– এগুলো সরকার করত। অথচ তা না করে, আধুনিকীকরণের নামে একেবারে কাঠামোটাই পাল্টে দেওয়া হল।
ন্যায় শাস্তে্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বুনিয়াদি নীতিগুলি বলে, (১) অভিযোগ প্রমাণ না করে কাউকে সাজা দেওয়া যাবে না, (২) অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পরিপূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। (৩) যতক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে নির্দোষ এবং অভিযোগ প্রমাণ করার দায় অভিযোগারীর। (৪) জামিনই নিয়ম, বন্দি রাখা ব্যতিক্রম। নতুন আইনে এই নীতিগুলির কোনও প্রতিফলন নেই। বরং ন্যায় বিচারের ও গণতন্ত্রের যতটুকু ছিটেফোঁটা, অন্তত খাতায়-কলমে হলেও ছিল, নতুন আইন চালু হওয়ায়় তা-ও ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ভারত পরিণত হবে একটা পুলিশি রাষ্ট্রে। আইনগুলি থেকে স্পষ্ট, ব্রিটিশ ভারতে দেশবাসী সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্বাধীন ভারতেও নাগরিকদের সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিন্দুমাত্র বদলায়নি।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এ দেশের সরকারগুলি জনস্বার্থবিরোধী মালিকতোষণ নীতি নিয়ে চলেছে। বিগত ১০ বছরে তারই কুৎসিত প্রকট রূপ ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। অত্যাচারিত নিষ্পেষিত মানুষ গমকে গমকে ফেটে পড়ছে বিদ্রোহে বিক্ষোভে। একে প্রতিহত করার জন্য, সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য, আইন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়েছে। নতুন তিনটি আইন এই ধারাবাহিকতারই সাম্প্রতিক রূপ। এই অগণতান্ত্রিক, মানবাধিকার বিরোধী আইনগুলিকে প্রত্যাহার করাতে সরকারকে বাধ্য করতে হলে, একে প্রতিহত করতে হলে, দেশব্যাপী জনমত সংগঠিত করে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প পথ নেই।
এই আইন পাশের পরেই এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন।