লঞ্চের ইঞ্জিনের আওয়াজ পেলেই দৌড়ে এসে একেবারে বুকজল পর্যন্ত নেমে কাতর আবেদন জানাচ্ছেন একদল মানুষ। শিশুকোলে মা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পর্যন্ত সামিল সেই দলে। লঞ্চকোনও গ্রামের কাছাকাছি এলেই একই দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে বারবার। এমনই দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে গোসাবা হয়ে সুন্দরবন এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া বহু স্বেচ্ছাসেবীকে। কত অসহায় হলে তবে সামান্য কিছু ত্রাণের জন্য শয়ে শয়ে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন কাতর আবেদন জানায়!
গোসাবা ব্লকের রানিপুর গ্রামে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী দলের সাথে পৌঁছে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা এককথায় মর্মস্পর্শী। ইয়াস ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেছে ২৬ মে, তার প্রায় একুশ দিন পার করেও গ্রামের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে হাহাকার। কারও ঘরবাড়ি সব গেছে, কারও পুকুরে লাগানো সামান্য পুঁজিটুকু নোনাজলে শেষ। মাছ ধরার জাল নৌকা সব কিছুর ক্ষতি হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। আবার কারও বা ঘরে মেয়েদের-শিশুদের পরার পর্যাপ্ত পোষাক নেই। হাজার হাজার বিঘা জমি নোনা জলের তলায়।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যাঁরা, মুখে বিষণ্নতার সাথে মিশে আছে লজ্জার জড়তা। যে হাত অভ্যস্ত চাষ করতে, মাছ ধরতে, নিজের রুটিরুজি নিজে খেটে অর্জন করতে সেই হাতগুলো পাততে হয়েছে সামান্য সাহায্যের জন্য! লজ্জার গভীরতা বোঝা যায় ত্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে ডুকরে কেঁদে ওঠা এক গ্রাম্য বধূকে দেখে। কথা বলতে এগিয়ে যেতে থামলেন, বুক ঠেলে ওঠা কষ্টটাকে গিলে নিয়ে বললেন, ‘বলতে পারেন আর কতকাল এমন করে বারে বারে সব হারাতে হবে? জানেন, একটা সংসারকে গড়ে তুলতে কত মেহনত লাগে? আর সে সব যখন ভেসে যায়, শুধু জিনিসের দাম ধরে তার হিসাব করতে পারবেন?’ এরপর যা বললেন, তা আজ সারা সুন্দরবনের মনের কথা– ‘বছর বছর ত্রাণের দয়া নয়, আমাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। দাঁড়াবেন আমাদের পাশে? কলকাতা শহরে ফিরে বলবেন আমাদের কথা? সরকারি কর্তাদের জানাবেন, আমরা দাক্ষিণ্যে আর ভুলব না, সমাধান আদায় করব।’ কী নাম বললেন, কান্নার বেগ এসে তা অস্পষ্ট করে দিল। ভাবলাম নাম নিয়েই বা কী হবে? এমন গাঁয়ের মা-বোনের সংখ্যা তো কম নয়! তাঁরা অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন ঘিরে, জানিয়ে দিয়েছেন এটাই তাঁদের মনের কথা।
চেন্নাইয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়া প্রশান্ত পয়ড়্যা, গত বছর লকডাউনের সময় থেকেই ঘরে। কাজ খুঁজে খুঁজে হয়রান। পুকুরে মাছ চাষ আর কিছু জমির ফসলের জোরে কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। এবারে সেটুকুও খুইয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় তাঁর নামে ঘর অনুমোদন হয়েছিল বছরখানেক আগে। কিন্তু পঞ্চায়েতবাবুদের কাটমানি দেওয়ার পর হাতে যা আছে তাতে দেওয়ালের অর্ধেকটা উঠেছে। এবারের দুর্যোগে পুরনো বেড়া, টিন আর মাটির ঘরটারও ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। এই বর্ষা কী করে কাটাবেন, ভেবে উঠতে পারছেন না। দুর্যোগের চিহ্ন গায়ে মেখেই জলকাদার ফোয়ারা তুলে শৈশবের আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে একদন ছেলেমেয়ে। তাদের দেখিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, প্রতাপ কুইল্যা, ‘ওরা যে কী হারালো তা বোঝার বয়স ওদের হয়নি। একবছরের বেশি স্কুল বন্ধ, এই এলাকায় অনলাইন পড়াশোনার কোনও প্রশ্নই নেই। সরকারের কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনেও হয় না! গরিব ঘরে যতটুকু শিক্ষার সুযোগ পেত তাও শেষ! লকডাউন উঠলে এদের অনেকেই হয়ত বাপ-কাকার হাত ধরে পরিযায়ী শিশুশ্রমিকের দলে নাম লেখাবে!’
ফিরতি পথে লঞ্চ একটু এগোতেই পাড় থেকে ভেসে এল সমবেত একটা চিৎকার– ‘ওগো, আমাদেরও কিছু দিয়ে যাও বাবু’। কিছুই যে দেওয়ার মতো আর অশিষ্ট নেই! কিন্তু দু’ঘন্টার জলযাত্রার প্রায় পুরোটাতেই দুই পাড়েই নানা জায়গায় প্লাবিত গ্রামের পাড় ধরে ম্যানগ্রোভ বন ঠেলে ছুটে আসছে দলকে দল মানুষ। কেউ চাইছেন একটু পানীয় জল, কেউ চাইছেন বাচ্চাদের খাবার। ওই এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুমন জানারও তখন দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। প্রশ্ন করলাম, ‘কী এর সমাধান?’ হাতাশ চোখে পাড়ের দিকে তাকিয়ে মাস্টারমশাই বলে চললেন, ‘সমাধান আছে, ম্যানগ্রোভ গাছের নিবিড় বাঁধ, আর তার অন্তত দুশো-তিনশো মিটার পিছনে স্থায়ী কংক্রিটের বাঁধ দিতে পারলে বারবার এমন ভাঙন হয় না।’ এর সাথে দরকার নবীন দ্বীপগুলি থেকে মানুষের বসতি তুলে তাদের সঠিক পুনর্বাসন দেওয়া। কিন্তু বিপুল খরচ, এই সব মানুষের জন্য সরকার কি এত করবে?’ প্রশ্ন জাগছিল, কেন করবে না? লঞ্চের সারেঙ বলে উঠলেন, ‘কেন করবে না বলুন তো? বড়লোকেদের কতটাকা ছাড় দেয় সরকার! গরিবের জন্য এটুকু দেবে না? আর এই কাজ তো শুধু এইকটা গ্রামের কাজে লাগবে না, সারা রাজ্যের মঙ্গল হবে, ঝড় ঝঞ্ঝা আটকাবে অনেকটা, আপনারাই তো বলেন!’ নিরুত্তর মাসাটারমশাই গভীর ব্যথায় ডুবে গেছেন চিন্তায়। জলে অধডোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি মুখ ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছে পিছনে। কিন্তু আসলে সরছে না, ছাপ ফেলে যাচ্ছে বিবেকের দরবারে– এ দাবি আদায়ের লড়াইতে কি পাশে থাকবে না তোমরা! উপস্থিত সকলের বিবেক অস্ফুট স্বরে কথা দিয়ে এল– থাকব। সুন্দরবনের নোনা বাদার মানুষের বাঁচার এ লড়াই জেতার দায় আজ আমাদেরও, দায় সারা বাংলার বিবেকবান মানুষের।