তুতিকোরিন আবার প্রমাণ করল সংগঠিত গণআন্দোলনই দাবি আদায়ের পথ

পাটনা

জয় হল তামিলনাড়ুর মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের৷ তুতিকোরিনের গ্রামবাসীদের সংগঠিত প্রতিবাদের সামনে পিছু হটতে হল ক্ষমতাসীন ডি এম কে সরকারকে৷ বহুজাতিক বেদান্ত গোষ্ঠীর দূষণ সৃষ্টিকারী স্টারলাইট তামার কারখানা চালু রাখা এবং সম্প্রসারণের জন্য রাজ্য সরকার সমস্ত রকম সহযোগিতা করে চলছিল৷ গ্রামবাসীদের দীর্ঘ গণআন্দোলনের চাপে পড়ে কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা করতে বাধ্য হল তারা৷

আন্দোলনরত গ্রামবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে এনে সরকার চেয়েছিল আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে৷ ভেবেছিল অত্যাচারের সামনে মানুষ ভয় পেয়ে পিছু হটবে৷ মানুষ পিছু হটেনি৷ মানুষ দৃঢ়পণ হয়েছিল, দূষণে আক্রান্ত হয়ে ক্যান্সার, চোখের অসুখ, ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি দুরারোগ্য রোগে দিনের পর দিন ধুঁকে ধুঁকে মরার স্থায়ী সমস্যাকে প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে তারা রুখে দেবে৷ জয় ছিনিয়ে আনতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন যাঁরা সেই ১৩ জন দৃঢ়পণ আন্দোলনকারী গ্রামবাসীকে লাখো সেলাম৷

সমাজের খেটে খাওয়া, শোষিত মানুষের সামনে নজির সৃষ্টি করল তুতিকোরিন৷ যেমন গণআন্দোলনের  ইতিহাসে  উজ্জল  দৃষ্টান্ত  হয়ে আছে সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের নাম৷ সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের প্রান্তে প্রান্তে ছোটবড় বহু গণআন্দোলন সংগঠিত হয়ে চলেছে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ সহ রুটি–রুজি ও জীবন–জীবিকার প্রয়োজনে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে বহুবার মানুষ আন্দোলনের ময়দানে নেমেছে৷ শাসক শ্রেণির শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার শিকার এ দেশের কোটি কোটি মানুষ শুধু পড়ে পড়ে মারই খায়নি– ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে৷ আর এ প্রয়োজনেই তারা সংগঠিত হয়েছে, প্রতিবাদে সামিল হয়েছে– গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ৷

বাঁকুড়া

কিছুদিন আগেই মহারাষ্ট্রে হাজার হাজার কৃষক কৃষিঋণ মকুব, ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন৷ মহারাষ্ট্র সরকার কৃষিঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল৷ সারা দেশেই প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করছেন৷ কৃষকরা নানা দাবিতে রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলনে নামছেন৷ আন্দোলনে সামিল কৃষক সমাজ অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছেন যে, সরকার তাঁদের দাবির প্রতি কত উদাসীন৷ অথচ যে দলই সরকারে বসে তারা ভোটের আগে কৃষকদের নিয়ে কতই না চোখের জল ফেলে আর গদিতে বসে তাদের একমাত্র কাজ হয় দেশি–বিদেশি মালিকদের স্বার্থরক্ষা৷ তারাই তখন গুলি করে, পিটিয়ে কৃষক–শ্রমিক–সাধারণ মানুষকে মারে৷

বর্তমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভোট রাজনীতির প্রচারের জোরে অনেকেই মনে করেন তাঁর পছন্দের দলটিকে জেতালেই তাঁর স্বার্থ রক্ষিত হবে৷ কিন্তু হয় ঠিক তার বিপরীত৷ যে দলই ক্ষমতায় যায় তারা দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির সেবার কাজটিই করে চলে৷ মানুষ যদি ভোট দিয়েই কর্তব্য শেষ মনে করে ঘরে বসে থাকে, আন্দোলনে সংগঠিত হয়ে দাবি আদায় করার বদলে কোনও নেতা এসে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে এমন অলীক চিন্তায় সুদিনের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে, তা হলে বারবার ঠকতে হয়৷ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষ তার অধিকার অর্জনের সঠিক দিশা পায়৷ নন্দীগ্রামে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বামনামধারী সিপিএম ক্ষমতায় বসে জনগণের আন্দোলনকে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছিল৷ তুতিকোরিনেও তাই৷ ক’জন জানত তুতিকোরিনের নাম? ক’জন জানত ওখানে কপার কারখানার দূষণের ব্যাপারে? যতক্ষণ না মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে কোনও সরকার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে? দাবি আদায়ের জন্য গ্রামবাসীদের শেষ পর্যন্ত আন্দোলনেই নামতে হয়েছে৷ অভিজ্ঞতা থেকে সেখানে মানুষ বুঝতে পেরেছে ভোটবাজ দলগুলি বা তাদের কোনও নেতাকে ধরে তাদের সমস্যা মিটবে না৷ আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই৷

উত্তরাখণ্ড

যতদিন প্রতিবাদ না করে ধুঁকতে ধুঁকতে মরেছেন কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন কেউই তাঁদের কথা ভাবার তোয়াক্কা করেনি৷ বরং সাহায্য করেছে বেদান্ত গোষ্ঠীকে৷ কিন্তু যখনই তাঁরা সংগঠিত হয়েছেন, নিজেদের জীবন দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, তখনই কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ আজ গোটা দেশ জেনেছে তুতিকোরিনের গ্রামবাসীদের আন্দোলনের কথা৷

সমাজের সকল অংশের মানুষ আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে৷ গ্রামবাসীদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনের ধারাতেই সমাজের যে কোনও অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব৷ তেমনই সম্ভব ক্ষমতালোভী দলগুলির মালিক তোষণকারী নীতি রুখে দেওয়া৷

(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)