কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজের গেটের বাইরে রাস্তার ধারে শ’তিনেক মানুষের বিশাল লাইন। বিনামূল্যে দুপুরের খাবার বিতরণের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গাড়িটা আসার সময় হয়ে গেছে যে! উল্টোদিকে গলির একটু ভেতরে গেলেই মিলবে পাঁচটাকায় ডিম ভাতের মা ক্যান্টিন। সেখানেও লাইনটা কিছু কম নয়। মনে পড়ে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাহেবের কথা– ভোটের জন্য বিরোধী দলের সরকারগুলো ‘রেউড়ি’ (খয়রাতি) বিতরণ করে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছে। কিন্তু চোখের সামনে এতগুলো মানুষকে একটু ভাতের জন্য এতক্ষণ লাইন দিতে দেখে ‘রেউড়ি’ শব্দটা ঠিক হজম হচ্ছিল না। এঁরা সবাই কি বিনা প্রয়োজনে শুধু ‘ফ্রি’-এর লোভে দাঁড়িয়ে গেছেন লাইনে? কথা বলে তা একেবারেই মনে হল না। বড় অভাবের জ্বালায় পোড়া পরিবারের একজনের পেটের আগুনটা একবেলার জন্য জুড়ানো গেলেও তাঁরা বাঁচেন। সেই আশাতেই তাঁরা লাইনে। তাহলে কীসে প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি? তাঁর সরকারও তো নানা সুবিধা বিতরণ করে, তার বেশিরভাগটা কাদের জন্য যায়? কাদের দিলে অর্থনীতির ক্ষতি হয় না, আর কাদের দিলে ক্ষতি হয়? এই সব ভাবতে ভাবতেই খবরের কাগজে চোখে পড়ল ২১ ডিসেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর কথাগুলো।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তাঁরা ক্ষমতায় আসার আগে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাঁধে ছিল বিপুল ঋণের বোঝা। আর ব্যাঙ্কগুলোর ঘাড়ে ছিল বিপুল অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। তাঁদের রাজত্বে তা কমে গেছে। কী করে? রিজার্ভ ব্যাঙ্কই জানিয়ে দিয়েছে পদ্ধতিটা। সরকারের নির্দেশে গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো ১০ লক্ষ ৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা ঋণ স্রেফ মুছে দিয়েছে। পরিভাষায় যাকে বলে ‘রাইট অফ’ করা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, না, আমরা এটা মকুব করিনি শুধু ব্যাঙ্কের খাতা শুধরে দিয়েছি। তিনি অবশ্য বলেননি, এর সঙ্গে যোগ করে ধরতে হবে, গত মার্চের হিসাব অনুযায়ী ৭ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ যা এখনও ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মোছা হয়নি। এই ঋণ আর কি কোনও দিন আদায় হবে? অর্থমন্ত্রী যতই আদায় করার কথা বলুন তিনি নিজেই সংসদে জানিয়েছেন, এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল বলে সময় সাপেক্ষ। বাস্তব হল, গত কয়েক বছরে এই ‘রাইট অফ’ করা ঋণের মাত্র দুই শতাংশের কম উদ্ধার করার প্রক্রিয়া চালু করা গেছে। এই টাকা কাদের ছিল? জনগণের ব্যাঙ্কে জমানো কষ্টের টাকাগুলোই এভাবে কর্পোরেটের ভাঁড়ারে ঢুকেছে এটাই সত্য নয় কি? তাহলে মোদি সরকারও ‘রেউড়ি’ বিতরণ করে। শুধু সাধারণ মানুষকে দেওয়া ছিটেফোঁটা ভর্তুকি কিংবা সুবিধাতেই তাঁদের ঘোর আপত্তি!
২২ ডিসেম্বর সংসদে অর্থমন্ত্রী মেনেছেন, তাঁরা আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের অবাধ সুবিধা বিতরণ করেন। একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাসত্ব করার যে অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ করেন, তার একটাও তিনি অস্বীকার করেননি। একচেটিয়া মালিকদের জন্য কর্পোরেট কোম্পানি কর ক্রমাগত কমিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পরোক্ষ করের বোঝা চাপানোর জন্য তিনি গর্বই প্রকাশ করেছেন। বিজেপি সরকার কর্পোরেট কোম্পানির আয়ের উপর কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ ও নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ করেছে। এর ফলে সরকারের ১ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা কম আয় হচ্ছে। এই ঘাটতি সরকার মেটাতে তারা জিএসটি এবং অন্যান্য সেস ও শুল্ক বসিয়ে পরোক্ষ করের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। যা দিতে হয়– একেবারে দরিদ্রতম মানুষটি থেকে শুরু করে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষকে। খরচ কমাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষা ক্ষেত্রে সরকার নিজের দায় কমিয়েছে, স্থায়ী কর্মীর বদলে কম পয়সায় চুক্তিভিত্তিক কর্মী দিয়ে কাজ করাচ্ছে। রেলে বয়স্ক নাগরিকদের কনসেশনও বন্ধ, ঘুরপথে রেলের ভাড়া বেড়েছে। জনকল্যাণের সমস্ত ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমিয়েছে, গ্রামীণ মানুষের রোজগার যোজনাতেও কাটছাঁট। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত আপাতত বিনামূল্যে রেশন চালু রাখার কথা বললেও তাতে বরাদ্দ বিশেষ বাড়ায়নি। বিশ্ববাজারে অশোধিত পেট্রোলিয়ামের দাম যতই কমুক দেশে তেল-গ্যাসের দাম এতটুকু না কমিয়ে তা থেকে চড়া হারে শুল্ক আদায় করছে। গরিবের জ্বালানি কেরোসিনে পর্যন্ত ভর্তুকি পুরোপুরি বন্ধ।
অর্থমন্ত্রীর একটাই দুঃখ, এসবের জন্য সংসদে বসে থাকা বিরোধীরা বিজেপিকে একাই দোষ দেয় কেন? এ ব্যাপারে কংগ্রেসই যে পথপ্রদর্শক। কংগ্রেস আমলে ১৯৯৪-এ কর্পোরেট আয়ের উপর কর ছিল ৪৫ শতাংশ, তা কমতে কমতে ২০০৫-এ দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ। সেই পথেই কর্পোরেট মালিকদের কষ্ট কমাতে তিনিও পিছিয়ে থাকতে চাননি।
জনস্বার্থ বলি দিয়ে আদানি, আম্বানি, টাটাদের মতো একচেটিয়া মালিকদের বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কাজে বিজেপি অবশ্যই এগিয়ে। নানা রাজ্যের উদাহরণ এই প্রসঙ্গে উঠতে অর্থমন্ত্রী তাঁদের এমন কাজগুলির কথা অস্বীকার করেননি। শুধু বলেছেন, আমরাই কি একা করি? তিনি কেরালায় আম্বানিদের হাতে ভিজিনজাম বন্দর তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, কংগ্রেসই ভিজিনজাম বন্দরকে থালায় সাজিয়ে আম্বানিদের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছে। সিপিএম আমলেও তা বদলায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, এই বন্দরের কারণে পরিবেশ ধ্বংস, তা আদানিদের হাতে দেওয়া ও মৎস্যজীবীদের গায়ের জোরে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে মৎস্যজীবীদের আন্দোলন দমন করতে সে রাজ্যের সরকারি দল সিপিএম এবং কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপি হাতে হাত মিলিয়ে মাঠে নেমেছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজস্থানে কংগ্রেস সরকার একই কায়দায় আদানিদের জমি দিচ্ছে। শুনতে শুনতে পশ্চিবঙ্গবাসীর মনে পড়বেই সম্প্রতি প্রস্তাবিত তাজপুর বন্দরের মালিকানা আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়ে তাদের কর্তাদের সামনে তৃণমূল নেতাদের হাত কচলানোর কথা। পিপিপি মডেলের মধ্য দিয়ে স্কুলশিক্ষাকে ধীরে ধীরে কর্পোরেট পুঁজির ছায়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তৃণমূল সরকারের পরিকল্পনার কথাও মনে পড়বে। মনে পড়তে বাধ্য, কর্পোরেট স্বার্থবাহী কেন্দ্রীয় তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন চলার সময়েই ২০২১-এর ৩১ ডিসেম্বর ও ২০২২-এর ১ জানুয়ারি গণশক্তি ও দ্য হিন্দু কাগজে প্রবন্ধ লিখে সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, কর্পোরেট কোম্পানিগুলির সাথে বসে বিষয়টি মিটিয়ে নিতে। আরও মনে পড়বে হঠাৎ করে বিজেপি জোট ছেড়ে আরজেডি, কংগ্রেস সহ সিপিএম-এর শরিক হওয়া নীতীশ কুমারের সরকার বিহারে আদানিদের, আম্বানিদের অত্যাধুনিক কৃষিপণ্য ব্যবসার পরিকাঠামো করতে অনেক আগেই ছাড়পত্র দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূল সরকার আম্বানিদের আদানিদের কৃষিপণ্য নিয়ে বৃহৎ ব্যবসার ছাড়পত্র দিচ্ছে। মনে রাখা ভাল, পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ও খাদ্যের পাইকারি ব্যবসার নামে কর্পোরেট পুঁজিকে ঢোকার ছাড়পত্র প্রথম দিয়েছিল সিপিএম সরকার। বিজেপি, কংগ্রেস, আপ কিংবা সিপিএম ইত্যাদিরা, যে যেখানে ক্ষমতায় গেছে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে। আপ সরকার দিল্লিতে বিদ্যুতে টাটা-আম্বানিদের কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কেন্দ্রীয় নীতির বিপক্ষে বললেও কার্যক্ষেত্রে কোম্পানিগুলির অন্যায্য মুনাফার বিরুদ্ধে কোনও ভূমিকা নেয়নি। অথচ ভোটবাজারে জনপ্রিয় হওয়ার তাড়নায় সরকারি কোষাগার থেকে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের দাম কম রাখছে। ফলে নাগরিকদের করের টাকা ঘুরপথে সেবায় লাগছে কর্পোরেট কোম্পানিরই। এতে মালিকরা খুশি, কর্পোরেটের পয়সায় ভোট তহবিলও ভরে ওঠে, ভোটেও সুবিধা হয়। ফলে অর্থমন্ত্রী মিথ্যে অভিযোগ করেননি।
অর্থমন্ত্রী খুশি তাঁদের সরকারের সাথে কংগ্রেসের কাজের অদ্ভূত মিলের জন্য। পেট্রোপণ্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা, ভর্তুকি বন্ধের কাজটা কংগ্রেসই শুরু করেছিল। তারা যাদের নির্দেশে চলেছে, বিজেপি ঠিক তাদের নির্দেশেই চলছে। পার্থক্য শুধু মাত্রায়। বিজেপি সরকার রাফাল যুদ্ধ বিমানের বরাত সরকারি কেম্পানি হ্যালের বদলে অনিল আম্বানিদের কোম্পানিকে পাইয়ে দিলে ভোটের আগে ‘সুট-বুটকা সরকার’ বলে কংগ্রেস খুব স্লোগান দেয়। কিন্তু দেশের মানুষের মনে তা দাগ কাটে না। কারণ মানুষ জানে খনি, ব্যাঙ্ক, বিমা, ইস্পাত, তেল, বিমান, টেলি সংযোগ ক্ষেত্র থেকে শুরু করে একেবারে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র পর্যন্ত সবকিছু বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার হোতা কংগ্রেসই। তারাই আর্থিক সংস্কারের নামে একচেটিয়া মালিকদের হাতে দেশের মানুষের সমস্ত সম্পদ তুলে দিতে শুরু করেছিল। তারাই চাকরির ক্ষেত্রে স্থায়ী নিয়োগ কমানো, আউট সোর্সিংয়ের হোতা। তাদের রাজত্বকালটা কয়েক বছর আগে বলে জনগণের উপর তখন আক্রমণের গতিটা বিজেপির এখনকার তুলনায় একটু কম ছিল। বিজেপি এই গতি মারাত্মক হারে বাড়িয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যে বিষময় ফল জনজীবনের উপর বর্তাচ্ছে তাতে কে বড় শোষক, কে কম, তার পার্থক্য খোঁজা মুশকিল।
শাসকদলগুলির এই একচেটিয়া মালিক-সেবা আসলে তাদের চরিত্রের মধ্যেই গাঁথা হয়ে আছে। তারা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবেই রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ। জনগণের ভোট পেতে কখনও কখনও অসহনীয় শোষণের বিরুদ্ধে তাদের কিছু কথা বলতে হয়। যে দল সরকারে আছে তার বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে গেলে বিরোধী আসন থেকে একচেটিয়া মালিকদের নামেও দুচারটে গালিও দিতে হয়। কিন্তু একচেটিয়া মালিকরা ভালই জানে এতে তাদের কোনও ভয় নেই। বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় বসা কিংবা ভোটের বিরোধী হিসাবে ভেসে থাকা নানা রঙের দলগুলি আসলে চরিত্রগতভাবে যে পুঁজিপতিশ্রেণির সেবক তা চিনতে মালিকদের ভুল হয় না। সংবাদমাধ্যমও কখনও কখনও জনগণের ওপর চলা শোষণের স্টিমরোলারটার বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভের বারুদ জমতে দেখে পুঁজিপতি শ্রেণিকে হুঁশিয়ারি দেয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ‘স্যাঙাৎতন্ত্রে’র অভিযোগ তোলে। যেন বিশেষ বিশেষ একচেটিয়া গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার ফলে জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বাড়ছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটার কোনও দোষ নেই! আসলে যে সত্যটা তারা চাপা দিতে চায়– এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচনে কে জিতবে, সরকার কে গড়বে, মন্ত্রী কে হবে এটা পুঁজিপতি শ্রেণিই ঠিককরে দেয়। একইভাবে কখন কোন বিরোধী দলকে সরকারের বিরুদ্ধে পপুলার করে তুলে জনসাধারণের ক্ষোভকে একটু প্রশমিত করতে হবে, তার জন্য কাকে প্রচারের আলোয় আনতে হবে তাও ঠিক করে তারাই। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থবাহী নানা দলের তরজাকেই দেশের মানুষের সামনে একমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য হিসাবে উপস্থিত করার ব্যবস্থা মালিকরাই করে দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ চেনানোর মতো কোনও দল থাকলে তাদের বক্তব্যগুলো সামনে না আসতে দেওয়ার জন্য তারা তৎপর।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বিরোধীদের উপর রেগে গিয়ে একটা সত্য বলে ফেলেছেন– মালিকের সেবাদাসত্বে বিজেপি, কংগ্রেস, আপ এমনকি বামপন্থী সিপিএম থেকে শুরু করে নানা সময় ক্ষমতার ভাগ পাওয়া দলগুলোর কেউই কম যায় না। মালিকদের সেবক হওয়ার লক্ষ্যে তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে, এই নিয়ে সংসদে তরজা চলে। আর মানুষকে বোঝায় এটাই গণতান্ত্রিক ‘ভোট যুদ্ধ’।