উত্তরপ্রদেশের বছর সাতেকের ছেলেটি ভাগ্যিস সংবিধান পড়েনি! সে জানে না, সংবিধানে লেখা আছে আমাদের দেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। সে না জানলেও সেখানে সরকারে আসীন বিজেপির যেসব নেতা-মন্ত্রী সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নিয়েছেন, তাঁদের তো এটা জানার কথা ছিল। উত্তরপ্রদেশে আমরোহার হিল্টন স্কুলের হেডস্যারও নিশ্চয়ই জানেন, গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের নিজস্ব খাদ্যাভাসে আইন আদালত পুলিশ প্রশাসন কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। অথচ তাঁর স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র টিফিনে বিরিয়ানি আনার ‘অপরাধে’ স্কুল থেকে বরখাস্ত হয়েছে শুধু নয়, এ নিয়ে তার মায়ের অভিযোগের উত্তরে প্রধান শিক্ষক যা বলেছেন, শুনলে কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে হয়। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মাকে ওই প্রধান শিক্ষক বলছেন, বন্ধুদের সঙ্গে ওই আমিষ টিফিন ভাগ করে খেতে চেয়ে আসলে সে তাদের ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষক হয়েও কোনও আইন, নৈতিকতা বা মানবিকতার পরোয়া না করে একটি শিশুর সামনে তার খাবার নিয়ে, ধর্মপরিচয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে তাঁর আটকালো না! এমনকি এর জন্য তাকে স্কুল ছাড়তে বলতেও বাধল না তাঁর! পেশায় শিক্ষক হলেও তাঁকে আর যাই হোক, মানুষ গড়ার কারিগর বলা যায় না।
প্রশ্ন হল, আমিষ পদ কি শুধু একটি বিশেষ ধর্মের মানুষই খেয়ে থাকেন? অন্যেরা খান না? কোন যুক্তিতে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের এই দেশে স্কুলে আমিষ খাবার আনা নিষিদ্ধ করে নিরামিষ খাবার বাধ্যতামূলক করা যায়? এমন নিয়ম যদি থাকেও, তা ভাঙলে এমন ‘গুরুতর’ শাস্তি দেওয়াই কি অপরাধ নয়? চোখ মেলে তাকালেই বোঝা যায়, আমিষ-নিরামিষ এখানে উপলক্ষ মাত্র। আসল হল তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষ, যা বিজেপি শাসিত ভারতবর্ষ জুড়ে নানা ঘটনায় দগদগে ক্ষতের মতো ফুটে বেরোচ্ছে। বিজেপি শাসনে ফ্রিজে গোমাংস রাখা বা গোমাংস খাওয়ার সন্দেহেই মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কোন মাসে আমিষ খাওয়া যাবে না তার নিদান দিতে পারেনপ্রকাশ্য জনসভায় শাসক দলের নেতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলার নিদান পর্যন্ত হাঁকতে পারেন। এই আগস্টেই হরিয়ানায় সাবির মল্লিক ও আরিয়ান মিশ্রের নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আরিয়ানকে ‘মুসলিম ভেবেই গুলি করেছিলাম’– এ কথা বলতে দ্বিধা করেনি বিজেপির মদতপুষ্ট গো-রক্ষক বাহিনীর এক সদস্য। কাজেই, আমরোহার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রমী বলার কোনও অবকাশ আজ আর নেই। ওই প্রধান শিক্ষকও নিশ্চিন্তেএবংনির্ভয়েএইকাজ করতে পেরেছেন শাসক বিজেপির সমর্থনের ভরসাতেই।
হায় রে স্বাধীন দেশ! একদিন এই দেশের স্বাধীনতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল আর আসফাকুল্লা খান! নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজে সব ধর্মের সৈনিকের একসঙ্গে বসে খাওয়ার প্রথা চালু করেছিলেন। বিজেপি ছাড়া অন্য শাসক দলগুলি এর আগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেছে এমন আদৌ নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই কংগ্রেস নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেনি। যার প্রভাবে এ দেশে স্বাধীনতাও এসেছে দেশভাগের মতো সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তের সাথে আপস করেই। স্বাধীন দেশের সমাজ মননেও ধর্মীয় বিভেদের বীজ রয়ে গেছে প্রবলভাবে। কিন্তু বিজেপি জমানায় সেই বীজ যেভাবে ডালপালা মেলছে, আরএসএস গুরু গোলওয়ালকরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অহিন্দুদেরদ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখার মানসিকতা যেভাবে স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত করার চেষ্টা হচ্ছে, সে ‘কৃতিত্ব’ অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর মন্ত্রিসভার। তাই স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পার করে যখন আমাদের জাত-ধর্ম-বর্ণের প্রাচীর ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, স্কুলের টিফিনবেলায় মৈনাক আর মইদুলের পায়েস আর বিরিয়ানি ভাগাভাগি করে খাওয়ার কথা ছিল, গাছতলায় বসে সুখ-দুঃখের গল্প করার কথা ছিল রুমা আর রুকসানার, তখন সাত বছরের একটি নিষ্পাপ বালক জানল, সে মুসলমান বলে হিন্দু বন্ধুদের সাথে খাবার ভাগ করে খাওয়া অপরাধ। সেই অপরাধে ওই স্কুলে আর পড়াই হবে না তার!
একটা লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গড়া হলেও ওই প্রধান শিক্ষকের যথারীতি কোনও শাস্তি হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বহিষ্কৃত বাচ্চাটির বকেয়া টাকা মকুব করে দেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এটাই নাকি স্কুলের তরফে ‘ক্ষতিপূরণ’! কিন্তু এই ঘটনা শিশুমনটিতে যে ভয়ঙ্কর অভিঘাত তৈরি করল, সারাজীবন ধরে হয়তো তাকে সে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। ক্ষতিপূরণের নামে শত শত টাকা দিলেও এই ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসের ক্ষতিপূরণ হবে কি?