দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল আর ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের উপর ৫ জানুয়ারি রাতে যে বর্বর আক্রমণ চালিয়েছে এবিভিপি–বিজেপি মদতপুষ্ট ফ্যাসিস্ট বাহিনী, তার সাথে একমাত্র তুলনা চলে মানবসভ্যতার চরম শত্রু হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কার্যকলাপের৷ ওরা এসেছিল কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, হাতে ছিল রড, লাঠি৷ এদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছাত্রীরাও৷ মেয়েদের হোস্টেলে ঢুকে তাদের অবাধে পিটিয়েছে, ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে৷ ওদের হাতে মার খেয়েছেন শিক্ষক–শিক্ষিকারাও৷ মাথা ফেটেছে, হাত ভেঙেছে তাঁদেরও৷ হোস্টেলে হোস্টেলে চালিয়েছে অবাধ ভাঙচুর৷ ছাত্র–ছাত্রী, শিক্ষিকা সহ অনেককেই ভর্তি করতে হয়েছে হাসপাতালে৷ আর সবটা দাঁড়িয়ে দেখেছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশের বাহিনী৷ তারা বরং আটকেছে, আহতদের সরিয়ে নিয়ে যেতে আসা অ্যাম্বুলেন্সকে, আটকেছে সাংবাদিকদের৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা আলো নিভিয়ে দিয়ে আক্রমণের আরও সুবিধা করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ৷ সংবাদমাধ্যমেই এসেছে কীভাবে বহিরাগত গুণ্ডাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবিভিপি এবং বিজেপির কর্মী– নেতারা৷ তাদের মধ্যে চালাচালি হওয়া হোয়াটস্যাপ মেসেজ যা প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তাতেও স্পষ্ট যে রক্ত ঝরিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই ওরা এসেছিল৷ একথাও স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সিগন্যাল না থাকলে পুলিশ কিছুতেই সব দেখেও এভাবে দর্শক হয়ে থাকত না৷
ধিক্কার জানিয়েছে সারা দেশ৷ কেন ওদের এত রাগ দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রী শিক্ষকদের উপর? কিছুদিন আগেই এনআরসি, সিএএ, এনপিআর–এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত জামিয়া মিলিয়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের উপর বিজেপি সরকারের পুলিশ বর্বরের মতো আক্রমণ চালিয়েছে৷ জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হোস্টেলে ফি–বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ৷ এর আগেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হোস্টেলে ঢুকে তাণ্ডব করেছে এবিভিপি–আরএসএস৷ দেশে প্রায় অঘোষিত জরুরি অবস্থা নামিয়ে আনা বিজেপি সরকার জানে, ওদের সর্বনাশা রাজনীতিকে মানছে না ছাত্রসমাজ৷ তারা ওদের চোখে চোখ রেখে ছুঁড়ে দিচ্ছে চ্যালেঞ্জ৷ ওই এবিভিপি মদতপুষ্ট বর্বর ফ্যাসিস্ট বাহিনীর যারা আসল শক্তি সেই আরএসএস–বিজেপি চেয়েছিল শুধু গায়ের জোর আর প্রশাসনের ক্ষমতাবলেই ওরা সারা দেশের ঘাড়ে এনআরসি চাপিয়ে দিয়ে কোটি কোটি মানুষের নাগরিকত্বকে অনিশ্চিত করে তুলবে৷ চাপিয়ে দেবে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণের জঘন্য আইন সিএএ৷ ভেবেছিল সরকারি স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের উপর বিপুল ফি–এর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ওরা আম্বানি–আদানি–টাটাদের মতো ধনকুবেরদের শিক্ষা ব্যবসাকে অবাধে বাড়তে সাহয্য করবে৷ বিশেষত সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেভাবে ফেটে পড়েছে তাতে চিন্তিত বিজেপি এবং তাদের মদতদাতা একচেটিয়া ধনকুবেরের দল৷ জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বর্ধিত ফি রুখতে পরীক্ষা বয়কটের মতো পদক্ষেপের সাহস দেখিয়েছেন৷ দিল্লি বিশ্ববিবদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের ক্যাম্পাসে নেতাজি এবং ভগৎ–সিংয়ের মূর্তির সাথে একত্রে ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দেওয়া বিজেপির আইকন সাভারকরের মূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে সাভারকরের মূর্তি সরাতে বাধ্য করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে৷ দিল্লি, হায়দরাবাদ, যাদবপুর, কলকাতা সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপির সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে৷ ওরা তাই ভয় পাচ্ছে৷ ওদের আশঙ্কা এনআরসি–সিএএ–এনপিআ বিরোধী আন্দোলনে যে মা তাঁর একমাস না পেরনো শিশুকে নিয়ে দিল্লির হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় শাহিনবাগে রাত জাগছেন, সেই মাতৃত্ব–নারীত্বের তেজ যদি ক্রমাগত সঞ্চারিত হয় ছাত্রদের হূদয় তন্ত্রীতে, তা হলে এ আন্দোলন আর শুধু স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ থাকবে না৷ তা খুঁজবে সমস্ত অন্যায়ের প্রতিকারের পথ, আন্দোলন নিতে পারে সুসংগঠিত, সচেতন রূপ৷ যে রূপকে ভয় পায় না এমন বুর্জোয়া শাসক দুনিয়াতে নেই৷
ছাত্রদের রক্ত ঝরেছে, তবু তারা লড়ছে, তাদের কুর্নিশ জানিয়েছে সারা দেশ৷ এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে ৬ জানুয়ারি এআইডিএসও–র ডাকে ছাত্র–ছাত্রীরা পালন করেছে সারা ভারত প্রতিবাদ দিবস৷ শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করার বিরুদ্ধে, ফি–বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, এনআরসি–সিএএ–এনপিআর রুখতে সারা দেশ জুড়ে ছাত্রদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এআইডিএসও–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৌরভ ঘোষ৷