দুটি ছবি কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে–একটি মুম্বাইয়ের, অপরটি দিল্লির। মুম্বাইয়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, জি-২০-র বৈঠক উপলক্ষে সেখানকার একটি হাইওয়ের ধারে যোগেশ্বরী বস্তি এলাকা ঘিরে দেওয়া হয়েছে সবুজ পর্দায়। সেখানকার গা-ঘিনঘিনে পরিবেশে খেটে-খাওয়া গরিব-গুর্বোদের পশুর মতো দিনযাপন পাছে চোখে পড়ে যায় বৈঠকে যোগ দিতে চলা দেশ-বিদেশের হোমরা-চোমরাদের! পাছে ফুটো হয়ে যায় দেশের অসীম উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ফাঁপানো ফানুস!
দ্বিতীয় ছবিটি শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকা দিল্লির একদল ফুটপাতবাসীর। ২০২৩-এ জি-২০-র সম্মেলনের জন্য শহর সাজাতে এদের ফুটপাতের ঝুপড়িগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সরকারি হোমে জায়গা মিলবে কি না, না মিললে আসন্ন প্রবল শীতের রাতগুলো কীভাবে কাটবে– এই আশঙ্কার ছায়া নিরুপায় মানুষগুলির চোখে-মুখে। অথচ এঁরা জানেনও না, জি-২০ কী, কী-ই বা তার কাজ। উচ্ছেদ করার আগে তাঁদের সে কথা জানাবার প্রয়োজন মনে করেননি সরকারি কর্তারা। এই দুটি ছবি যেন জি-২০-র সভাপতিত্বের পদ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহচরদের বাগাড়ম্বরের ভণ্ডামির আড়ালে ঢেকে রাখা দেশের চূড়ান্ত দুর্দশাগ্রস্ত রিক্ত চেহারাটির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এই পদপ্রাপ্তি নিছকই নিয়মমাফিক
গত ১ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জি-২০-র সভাপতিত্বের দায়িত্ব বর্তেছে ভারতের উপর। এই জি-২০ হল আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি সহ বিশ্বের ২০টি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশের একটি যুক্তমঞ্চ যার অন্যতম সদস্য ভারত। গত বছর ১৬ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এই সংস্থার এক সভায় ভারতের সভাপতিত্ব ঘোষণা করা হয়। তারপরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্তব্য করেছেন, জি-২০-র সভাপতিত্ব লাভ প্রতিটি ভারতবাসীর কাছে গর্বের। কিন্তু কিসের গর্ব ভারতবাসীর, কোন দিক থেকে গর্ব?
এ আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, বিশ্ব অর্থনীতির স্থায়িত্ব রক্ষা, বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলা করা ইত্যাদি অনেক বড় বড় কথার আড়ালে জি-২০-র আসল কাজ হল নিজের নিজের দেশের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে অন্য দেশের একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে দর-কষাকষি করা, মুনাফার তাগিদে আইনি-বেআইনি সুযোগ-সুবিধা গুছিয়ে নেওয়া। এ সবের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কোনও রকম সম্পর্কই কার্যত নেই। রীতি অনুযায়ী জি-২০-র সভাপতিত্ব রুটিনমাফিক এবার বর্তেছে ভারতের উপর, তাতে প্রত্যেক ভারতবাসী কেন গর্বিত হতে যাবেন–তা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারওরই বোধহয় জানা নেই! আসলে হয় কথায় নয় কথায় ভারতকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিলানো ও প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসাবে তুলে ধরার জন্য যে ব্যাপক বাগাড়ম্বর বিজেপি নেতারা করে থাকেন, এ হল তারই অঙ্গ।
কী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী? ১ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘জি-২০-তে ভারতের সভাপতিত্ব বিশ্বজনীন একাত্মবোধের প্রসারে কাজ করবে।’ তাঁর বক্তব্য, ‘আমাদের স্লোগান হবে– এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। বলেছেন,‘এ কথা নিছক স্লোগান নয়। মানবিক পরিস্থিতির সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তনের কথা বিচারের মধ্যে এনেই এ কথা বলা হয়েছে, যা আমরা সকলে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছি’। কী সেই পরিবর্তন? না, তিনি বলেছেন, ‘আজ বিশ্বের সমস্ত মানুষের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য যা প্রয়োজন তা যথাযথ ভাবে উৎপাদনের ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।’ বলেছেন, ‘আজ ভারত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলা একটি বৃহৎ অর্থনীতি। আমাদের নাগরিক-কেন্দ্রিক সরকার প্রতিভাবান যুবশক্তির সৃজনশীলতাকে লালন-পালন করার পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে-পড়া মানুষটিরও যত্ন নেয়।’
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বেহাল দশা
প্রধানমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত এই সব শ্রুতিমধুর কথাগুলিকে বাস্তবের সঙ্গে একবার মিলিয়ে দেখা যাক। চোখ বোলানো যাক দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের হাল-হকিকতের দিকে। এরাই তো দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ! দেখা যাক, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের কেমন যত্নে রেখেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’-এ মোট ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১০৭-এ। এই রিপোর্ট অনুযায়ী অপুষ্টির কারণে বয়স অনুপাতে কম ওজনের শিশুর সংখ্যায় বিশ্বের মধ্যে ভারতের স্থান প্রথম। খোদ সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের গত বছরের রিপোর্ট বলছে ২০১৯-‘২১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রতি তিনজনে একজনের অপুষ্টি, অনাহারের কারণে বয়সের তুলনায় বৃদ্ধি কম। সরকারি তত্ত্বাবধানে কত যত্নে এই শিশুরা দেশের আগামী দিনের নাগরিক হিসাবে বড় হয়ে উঠছে– স্পষ্টই বোঝা যায়! সরকারি হিসাবই বলছে, অন্তত ২৩ কোটি ভারতবাসী দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। না খেতে পেয়ে বা ঠিকমতো খাবার না জোটায় প্রতিদিন এ দেশে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন চাষি আত্মহত্যা করে জীবনের জ্বালা জুড়ায়। অথচ এ কথা তো ঠিক যে খাদ্য উৎপাদনে ভারত আজ যথেষ্ট এগিয়ে। সরকারি গুদামগুলিতে খাদ্যশস্য উপচে পড়ে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে তা কেনার ক্ষমতা নেই। সেই ক্ষমতা জোগাবার কোনও বন্দোবস্তই করেনি জি-২০-র সভাপতিত্ব পেয়ে গর্বিত দেশের সরকার। কোটি কোটি মানুষের ঘর বলতে ফুটপাতের ছাদহীন আস্তানা, কিংবা মাঠে-ঘাটে রেললাইনের ধারে কোনও রকমে বানিয়ে নেওয়া মাথা গোঁজার ঝুপড়ি। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরের দুঃশাসনের এই লজ্জা ঢাকবে কীসে!
সাম্প্রতিক কোভিড অতিমারিতে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে সরকারি হিসাবেই মারা গেছেন ৪০ লাখ মানুষ। এই হিসাবের বাইরে আরও কতজন আছেন, বাস্তবে তার হিসাব নেই। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের একের পর এক অবিবেচক সিদ্ধান্তের দরুণ রাতারাতি কাজ হারিয়েছেন ১২ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ৩ লক্ষ কল-কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের ৬-৭ কোটি সংস্থা। ফলে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। যাঁরা কোনও একটা কাজ জোগাড় করতে পেরেছেন তাদের ৮০ শতাংশই নিয়মিত বেতন না পেয়ে, অত্যন্ত কম বেতনে, কোনও রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। ক্ষিদের জ্বালায় বিপর্যস্ত কর্মহীন দুর্দশাগ্রস্ত এ হেন ভারতের জি-২০-র সভাপতির পদ পাওয়া গর্বের বৈ কী!
সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু একচেটিয়া মালিকদের সুবিধা দেওয়া
প্রধানমন্ত্রী তাঁর লেখায় মন্তব্য করেছেন, ‘দেশের উন্নতি ঘটাতে আমরা উপর-তলা থেকে নিয়ন্ত্রণ কায়েমকারী প্রশাসন চালাইনি। তার বদলে নাগরিকদের নেতৃত্বে জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছি।’ জনগণের কতখানি উন্নয়ন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকার ঘটিয়েছেন, তার ছবি তো দেখা হল। কিন্তু তাই বলে কি দেশের কোনওই উন্নয়ন ঘটেনি! অবশ্যই ঘটেছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে ভারতের ১০০ জন সর্বোচ্চ ধনপতির সম্পদ বেড়েছে ১২ লক্ষ ৯৭ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতি গৌতম আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম পুঁজিপতিতে পরিণত হয়েছেন। কেন্দ্রের ‘যত্নশীল’ বিজেপি সরকার করের হার কম করে, ছাড় দিয়ে, ঋণ মকুব করে, শিল্পে উৎসাহ দানের নামে বিপুল টাকা ভরতুকি পাইয়ে দিয়ে এইসব একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফা বহু গুণ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে যাচ্ছে। অথচ দেশের মানুষ আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার সামান্যতম সরকারি প্রচেষ্টাও নেই। বাস্তবে এই সরকারের যা কিছু দায়বদ্ধতা তা শুধু একচেটিয়া পুঁজিপতিদের প্রতিই। সাধারণ মানুষ তাদের চোখে নিছক ভোটারের বেশি আর কিছু নয়। তাই দেশ জুড়ে এই বীভৎস বৈষম্য। এ যদি ‘নাগরিকদের নেতৃত্বে জাতীয় উন্নয়ন’ না হয় তো তা আর কী!
দুর্দশাগ্রস্ত নারীসমাজ
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মহিলাদের অংশগ্রহণ ছাড়া বিশ্বের বিকাশ সম্ভব নয়। জি-২০-র কর্মসূচিতেও আমাদের মহিলা নেতৃত্বাধীন উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ কথাটি শুনতে চমৎকার। কিন্তু বাস্তবে দেশে নারীসমাজের অবস্থা কী? সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই অসংখ্য ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নারীহত্যা, পণ দিতে না পারায় খুন, কন্যাসন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার ঘটনা সামনে আসছে। অবাধে ঘটে চলেছে কন্যাভ্রূণ ও কন্যাসন্তান হত্যার ঘটনা। সরকারি তথ্যই বলছে, দেশে প্রতিদিন ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়। প্রতিদিন গড়ে খুন হন ৮০ জন নারী। দৈনিক গড়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয় পণ দিতে না পারার কারণে। বাস্তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যে আরও কয়েকগুণ বেশি, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি রিপোর্টে পাওয়া যাচ্ছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৯০ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে ভারতে। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট বলছে, গোটা বিশ্বে যত কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই ঘটে ভারতে। ২০২১-এর ডিসেম্বরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিজেই সংসদে জানিয়েছে, ২০২০ সালে দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৫০৩টি।
প্রশ্ন ওঠে, যে প্রধানমন্ত্রী জি-২০ সংক্রান্ত কর্মসূচিতে নারীদের প্রাধান্য দেওয়ার কথা ঢাক পিটিয়ে প্রচার করছেন, সেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর ৮ বছরের শাসনে এই পরিস্থিতি দূর করার জন্য কী করেছেন! এই সেদিনই তো দেখা গেল, কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার সময়ে অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ এবং তাঁর শিশুকন্যা সহ পরিবারের অন্যান্যদের খুন করেছিল যে ১১জন দুষ্কৃতী, স্বাধীনতা দিবসে মহা সমারোহে তাদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হল। গুজরাটের বিজেপি নেতারা তাদের বরণ করে নিলেন ফুল দিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে। এই তো মহিলাদের প্রতি, তাঁদের মর্যাদার প্রতি নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপি-র মনোভাব! কতখানি নির্লজ্জ হলে তবে এ সবের পরেও উন্নয়নের কাজে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ঢাক পেটানো যায়!
‘গণতন্ত্রের জননী’র দেশে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ
নরেন্দ্র মোদি তাঁর লেখায় ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘বিশ্বের মধ্যে ভারতে রয়েছে সমৃদ্ধ ও জীবন্ত গণতন্ত্র …’। গণতন্ত্র বলতে যদি তিনি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের নির্মম শোষণে সাধারণ মানুষের ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বোঝান, গণতন্ত্র বলতে নরেন্দ্র মোদি যদি সংসদীয় ব্যবস্থার জাঁকজমকের আড়ালে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার কায়েম করার অবাধ স্বাধীনতা বোঝান, তাহলে সত্যিই ‘ভারতে রয়েছে সমৃদ্ধ ও জীবন্ত গণতন্ত্র’। সর্বশক্তি দিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সরকারগুলির কার্যকলাপে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরই কার্যত খেয়ে-পরে সুস্থভাবে মানুষের মতো বাঁচার গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও নেই। বহু লড়াইয়ে অর্জিত চাষি-মজুরদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি একের পর এক ছিনিয়ে নিচ্ছে শাসকরা। বিরোধী কণ্ঠস্বর কঠোর ভাবে দমন করা হচ্ছে। সরকারের যে-কোনও নীতির বিরোধিতাকেই দেশ বিরোধিতা বলে দাগিয়ে দিয়ে বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলে বন্দি রাখা হচ্ছে বিরোধীদের। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশের পুলিশ ও প্রশাসন আজ ব্যাপক দুর্নীতির কবলে। এই তো এ দেশের গণতন্ত্রের নমুনা।
নরেন্দ্র মোদির ‘জীবন্ত গণতন্ত্রের’ দেশে নির্বাচনগুলি আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেদার টাকা ছড়িয়ে, পেশিশক্তি আর প্রচারমাধ্যমকে ব্যাপক ভাবে কাজে লাগিয়ে, জনসাধারণের কষ্টার্জিত টাকা নয়ছয় করে কারচুপির মাধ্যমে ভোটে জেতার কৌশল। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সংসদ সদস্যদের ৪৩ শতাংশের নামেই ক্রিমিনাল কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে, যাদের ৫৫ শতাংশই আবার প্রধানমন্ত্রীর নিজের দল বিজেপির সদস্য। বাস্তবে সংসদ বর্তমানে হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু ধনপতি, মুনাফাখোর পুঁজিমালিক, মাফিয়া ডন, ধর্ষণকারী, খুনি ও সমাজের উঁচুতলার কয়েকজন প্রাক্তন প্রশাসকের আড্ডাখানা। এ গণতন্ত্রে গরিব মানুষের নির্বাচিত হওয়ার বাস্তবে কোনও সুযোগই নেই।
সাধারণ মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমে অর্জিত শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে যে সাংসদরা নির্বাচিত হন, তাঁদের কাজের বহরটা একবার দেখে নেওয়া যাক। দেখা যাচ্ছে, ২০২১-এর বর্ষা অধিবেশনের দুটি সপ্তাহে যেখানে ১০৭ ঘন্টা সংসদ অধিবেশন হওয়ার কথা, সেখানে নষ্ট করা হয়েছে ৮৯ ঘন্টা। কাজ হয়েছে মাত্র ১৮ ঘন্টা। গত বছরের ১ আগস্ট পর্যন্ত লোকসভায় ও রাজ্যসভায় কাজ হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ২৩ ঘন্টা ও ১৩ ঘন্টা। দেখা যাচ্ছে, সংসদে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলি নিয়ে এখন আলাপ-আলোচনার বদলে সদস্যরা ব্যস্ত থাকেন পারস্পরিক কাদা-ছোঁড়াছুড়িতে। গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলির বেশিরভাগই বিনা বিতর্কে পাশ করানো হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে বিজেপি সদস্যরা বহু ক্ষেত্রেই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই বিলকে আইনে পরিণত করেন। জনসাধারণ জানতেও পারেন না, শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে তাদের উপর অধিকতর নিপীড়ন চালানোর জন্য গণতন্ত্রের স্লোগান দিতে দিতেই কী স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে সংসদের ভিতরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আইন! বাস্তবে এই হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি কথিত সমৃদ্ধ ও জীবন্ত ভারতীয় গণতন্ত্রের আসল চেহারা।
‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’-এর কদাকার রূপ
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের জি-২০-র মন্ত্র হল ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’।
অসাধারণ বত্তৃতাবাজি, সন্দেহ নেই! ২০১৪ সাল, যখন থেকে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, ভারতের মানুষ তখন থেকেই এই ‘একত্ব’-এর চমৎকার রূপ প্রত্যক্ষ করছে। মুসলিম সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি প্রকাশ্যে ঘৃণা ছড়ানো, গায়ের জোরে সংখ্যালঘু নাগরিকদের কাছ থেকে বৈধ নাগরিকত্বের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা, মুসলিম-খ্রিস্টান-আদিবাসী ও তথাকথিত দলিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে লাগাতার শত্রুতা চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা একের পর এক সেই একত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছে। সঙ্গে গোমাংস রয়েছে এই সন্দেহে পিটিয়ে খুন, ‘লাভ জিহাদ’-এর ধুয়ো তুলে ভিন্নধর্মী তরুণ-তরুণীর বিবাহে বাধা দিতে তাদের উপর হামলা, ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করা তো সাধারণ ঘটনা, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার কায়েম হওয়ার পর থেকে আরএসএস-বিজেপি-সংঘ পরিবারের সদস্য দুষ্কৃতীরা রাজ্যে রাজ্যে একের পর এক পরিকল্পিত দাঙ্গা লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদি কথিত একত্বের প্রমাণই বোধহয় দাখিল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ভোটে ফয়দা তোলাই আসল উদ্দেশ্য
প্রধানমন্ত্রীর এই বাগাড়ম্বরের আসল উদ্দেশ্য একটাই– তা হল জি-২০-র সভাপতিত্বের পদ কাজে লাগিয়ে ভোটে ফয়দা তোলা। এবং আরএসএস-বিজেপির চিরাচরিত পথ ধরে সেই ভোটে হিন্দুত্ববাদের প্রচারই যে তুরুপের তাস, তা জি-২০-তে ভারতের প্রতীক চিহ্ন বা ‘লোগো’টি দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। লোগোয় গেরুয়া রঙের পদ্মফুলের উপর বসানো রয়েছে একটি ভূ-গোলকের ছবি। অত্যন্ত কৌশলে এই লোগোয় বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্মফুল ব্যবহার করা হয়েছে, যার রঙ বিজেপির দলীয় ঝান্ডার মতোই গেরুয়া।
শুধু তাই নয়, কেন পদ্মফুল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য, বিশ্বাস ইত্যাদির উল্লেখ করে শেষে বলেছেন, জ্ঞান ও সম্পদের দুই দেবীরই আসন হল পদ্মফুল। স্পষ্টতই তিনি সরস্বতী ও লক্ষ্মী– এই দুই হিন্দু দেবীর কথা বলেছেন। সংবিধান অনুসারে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রধানমন্ত্রীই না সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে প্রবল ভক্তিভরে সংবিধানে মাথা ঠেকিয়ে সংসদে প্রবেশ করেছিলেন! তাহলে কিসের ভিত্তিতে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ভারতে জি-২০-র লোগোতে দুই হিন্দু দেবীর প্রতীক ব্যবহার করেছেন? আসলে এটাই নরেন্দ্র মোদি কথিত একত্বের প্রকৃত আগ্রাসী রূপ। হিন্দু আধিপত্যবাদী দল বিজেপির নেতা হিসাবে এভাবেই প্রধানমন্ত্রী একদিকে হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থ পূরণের মতলব আঁটছেন। এটাই বিজেপি দল তথা তার নেতা-মন্ত্রীদের লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য পূরণেই জি-২০-র সভাপতির পদটিকে ব্যবহার করে বড় বড় কথার ফোয়ারা ছুটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্লজ্জের মতো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন দেশজোড়া বীভৎস বৈষম্য আর মানুষের চূড়ান্ত দুর্দশার কঙ্কাল চেহারাটিকে। কাব্য করে বলেছেন, জি-২০-র প্রতীক চিহ্নে পদ্মফুলের সাতটি পাপড়ি সাত সুরের প্রতীক, যাদের মিলনে তৈরি হবে সুরেলা ঐকতান। কিন্তু বাস্তবে সুরেলা ঐকতানের বদলে দেশের আকাশ-বাতাস ভরে উঠছে গরিবি বেকারি মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরন্ন অপুষ্ট শিক্ষাবিহীন স্বাস্থ্যহীন মানুষের আর্তনাদে। প্রধানমন্ত্রীর লজ্জাহীন বাগাড়ম্বরের চড়া আওয়াজ সেই আর্তনাদ চাপা দিতে পারছে না।
(তথ্যসূত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১ ডিসেম্বর, ‘২২ ও প্রোলেটারিয়ান এরা, ১ ডিসেম্বর, ‘২২ সংখ্যা)