৫ এপ্রিল এআইডিএসও-র ডাকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র বিরুদ্ধে দিল্লিতে ছাত্র বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল। সংসদ ভবন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে, যন্তরমন্তরে পুলিশের সাজ সাজ রব সকাল থেকেই। সময় যত গড়াচ্ছে, ব্যারিকেডের সামনে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে।
কেরালা থেকে এসেছেন মিথুন আর। কী কারণে এতদূর থেকে আসা? স্পষ্ট উত্তর দিলেন–কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি-২০ লাগু করে আমাদের লেখাপড়ার যতটুকু সুযোগ ছিল তা-ও কেড়ে নিচ্ছে। এই শিক্ষানীতিতে স্কুল কলেজের ঢালাও বেসরকারিকরণের সুপারিশ রয়েছে। আমি সরকারি স্কুল থেকে সদ্য পাশ করেছি। সেই স্কুলটা পিপিপি মডেলে এক মালিককে বিক্রি করে দেবে। এরকম আরও অনেক স্কুল আছে। আমরা গরিব ঘরের সন্তান। টানাটানির সংসারে আমার দাদা বি এ পাশ করেছে। অনেক খরচ করে বি এডে ভর্তি হয়েছে। এখন যদি তিন বছরের বদলে চার বছরের বি এ কোর্সে আমায় পড়তে হয় তো টাকা কই? অথচ সরকার আমাদের সমস্যার কথা শুনতেই চাইছে না।
মঞ্চে ব্যানার বাঁধা শেষ করে নেমে এলেন গাজিয়াবাদের রাহুল সিং। বললেন, করোনার দু’বছরে অনলাইনে লেখাপড়া হয়নি। কিচ্ছু শেখেনি কেউ। তা সত্ত্বেও এই শিক্ষানীতি অনলাইনে লেখাপড়া বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞানের মতো বিষয় নিয়ে পড়া ছাত্রদের কী হবে বলুন তো? আমার সাবজেক্ট ইতিহাস। এই বিজেপি সরকার দেশে নানা ঐতিহাসিক জায়গার নাম বদলের সাথে ইতিহাস বইয়ের নানা ঘটনাও বদলে দিচ্ছে। ইতিহাসকে ওদের দলের মতো করে লিখছে। আমাদের ঠিক ইতিহাস জানতে দেওয়া হবে না। এর চেয়ে বড় ষড়যন্ত্র আর কী হয়?
ওরা বলছে, সব বোর্ড তুলে দিয়ে একটাই কেন্দ্রীয় বোর্ড করবে। রাজ্যে রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কেন্দ্রীয় এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হবে। পাশ করলে কোন রাজ্যে ভর্তির সুযোগ মিলবে ঠিক নেই। গরিব নিম্নবিত্ত ছাত্ররা ক’জন পারবে এলাকার কলেজ ছেড়ে ভিন রাজ্যে পড়তে? ছাত্রদের ক্ষোভের কারণ যথার্থ।
কিন্তু আপনারা শিক্ষার বৃত্তিমুখীকরণের বিরোধিতা করছেন কেন? সরকার তো বলছে বৃত্তিমূলক শিক্ষা পেলে কর্মসংস্থান উপযোগী দক্ষ ছেলেমেয়ে তৈরি হবে!
ভাঁওতা। সম্পূর্ণ ভাঁওতা। দেখছেন না, দেশে এখনই কত উচ্চশিক্ষিত বেকার। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বসে আছে। তারা কেউ অযোগ্য নয়। আসলে দেশে বাজার নেই, মন্দার কারণে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠছে না। চাকরিও তেমন নেই। এ অবস্থায় কিছু হাতের কাজ শিখিয়ে দিলে চাকরি হবে?
জবাবি মুখের ভীড় বেড়ে চলেছে। বুকস্টলের সামনে ঝাড়খণ্ডের ছাত্রী খুশবু ক্ষোভের সাথে বললেন, সরকার নবজাগরণের শিক্ষাচিন্তার বিপরীতে গিয়ে মধ্যযুগের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কূপমণ্ডুকতার প্রসার ঘটাতে চাইছে। মেয়েদের আবার গৃহবন্দি করতে চাইছে। সভ্যতার সামনে এ বড় বিপদ। একে রুখতেই হবে।
একে একে মিছিল আসছে। প্রত্যয়ী মুখের ভিড় বেড়ে চলেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০ বাতিলের দাবি নিয়ে সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ভি এন রাজশেখরের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ডেপুটেশন দিতে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে রওনা হয়েছেন। কর্মসূচির সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠিয়েছেন জয়েন্ট ফোরাম ফর মুভমেন্ট অন এডুকেশনের সাধারণ সম্পাদক অমিয় মহান্তি, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তার সিং সারাভা চেয়ার প্রফেসর ভীম ইন্দর সিং, জেএনইউ-এর অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা, অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অনীশ রায় প্রমুখ। ধরনা মঞ্চের সামনে তখন প্রায় সব রাজ্য থেকে আসা হাজার হাজার ছাত্রের সমাবেশ। তাদের উদ্দেশে এআইডিএসও-র সাধারণ সম্পাদক সৌরভ ঘোষ বলছেন, ‘এ লড়াই শিক্ষা মনুষ্যত্ব সভ্যতা বাঁচানোর লড়াই। ঘরে ঘরে এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এআইডিএসও। কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্তে্রর বিরুদ্ধে জনমত আরও তীব্র করতে কোটি কোটি সই নিয়ে দিল্লি অভিযান হবে। প্রয়োজনে কৃষক আন্দোলনের মতোইদেশের ছাত্রসমাজ দিল্লি সহ গোটা দেশে শাসকদের অবরুদ্ধ করবে। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে রক্ষা করবে শিক্ষার অধিকার। মঞ্চে তখন সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে উপস্থিত অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটির কেন্দ্রীয় সচিবমণ্ডলীর সদস্য গিরিবর সিং। সূর্য তখন মধ্য গগনে। রাস্তার দুধারে গাছের ঘন ছায়া ছোট হয়ে আসছে। ব্যারিকেডটা দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুলিশ, আধাসেনা, জলকামান সারি সারি। দুপুরের গনগনে রোদ মাখছে যন্তর মন্তরের ধরনাস্থল, প্রতিবাদী মুখ, আসমুদ্রহিমাচল।