বিজেপি এবং সংঘ পরিবার যখন ভারতের মুসলিমদের বিদেশি বলে চিহ্নিত করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং জনসাধারণের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে তখন দেখা যাক ‘ভারতীয় সভ্যতা ও ইসলাম’ নিয়ে এ দেশের নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা কী বলছেন।
জাতি গঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘কোনও সভ্যতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়ে উঠিয়াছে এরূপ দৃষ্টান্ত একটিও পাওয়া যায় না। অপর একটি সুসভ্য জাতি আসিয়া কোনও জাতির সহিত মিশিয়া যাওয়া ছাড়াই সে জাতি সভ্য হইয়া উঠিয়াছে– এ রূপ একটি জাতিও জগতে নাই।’’ (বিবেকানন্দ রচনাবলি, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৪২)
এই জাতি গঠনের প্রক্রিয়া রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘‘শক, হুন, পাঠান, মোগল– এক দেহে হল লীন।’’
ভুল করে এক শিষ্য শাহজাহানকে বিদেশি বলায় বিবেকানন্দ তার ভুল শুধরে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘শাহজাহান নিজেকে ‘বিদেশি’ নামে অভিহিত হতে শুনে কবরের ভিতর থেকে ফিরে দেখতেন কে তাঁকে ওই রকম বলেছে।’ (স্বামীজিকে যেমন দেখিয়াছি, ভগ্নী নিবেদিতা, পৃ. ১৬৪)।
ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, ‘‘মোগলদের গরিমা স্বামীজি শতমুখে বর্ণনা করিতেন। … একবার তিনি শাহজাহানের কথা বলিতে বলিতে সহসা উৎসাহভরে বলিয়া উঠিলেন, আহা, তিনি মোগলকুলের ভূষণস্বরূপ ছিলেন। অনন্য সৌন্দর্যানুরাগ ও সৌন্দর্যবোধ ইতিহাসে আর দেখা যায় না। … আকবরের কথা তিনি আরও বেশি করিয়া কহিতেন। আগ্রার সন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাথ সাধিত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামীজির কণ্ঠ যেন অশ্রু গদগদ হইয়া আসিত।’’(৯/১৭৫)
এ দেশের জাতীয় জীবনে ইসলামের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই একমাত্র আশা।’ (৮/২৬)
‘‘আমি মানুষ চক্ষে দেখিতেছি, এই বিবাদ, বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহামহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে।’’ (৮/২৬)
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘ভারতবর্ষ তার আপন মনকে জানুক এবং আধুনিক সকল লাঞ্ছনা থেকে উদ্ধার লাভ করুক। রামানুজ, শংকরাচার্য, বুদ্ধদেব প্রভৃতি বড়ো বড়ো মনীষীরা ভারতবর্ষে বিশ্ব সমস্যার যে সমাধান করবার চেষ্টা করেছিলেন তা আমাদের জানতে হবে। জোরাস্তেরীয় ইসলাম প্রভৃতি এশিয়ার বড়ো বড়ো শিক্ষা সাধনার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ভারতবর্ষের কেবল হিন্দু চিত্তকে স্বীকার করলে চলবে না। ভারতবর্ষের সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থপতিবিজ্ঞান প্রভৃতিতেও হিন্দু, মুসলমানের সংমিশ্রণে বিচিত্র সৃষ্টি জেগে উঠেছে। তারই পরিচয় ভারতবর্ষীয়ের পূর্ণ পরিচয়। (রচনাবলি, ১৪শ খণ্ড, পৃ- ২৫১, বিশ্বভারতী সংস্করণ)
তিনি আরও বলেছেন, ‘মুসলমানেরা পুরুষানুক্রমে জন্মিয়া ও মরিয়া এ দেশের মাটিকে আপন করিয়া লইল। মুসলমান রাজত্ব ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাইরে তার মূল ছিল না।’
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বলেছেন, ‘‘মুসলমানরা ভারতে তাদের নিজেদের বাসভূমি স্থাপন করেছে। তারা ভারতীয় জীবনে এক নতুন ও অদ্ভুত জীবনীশক্তি নিয়ে এসেছে। এই জীবনীশক্তির খুব প্রয়োজন ছিল।’’