একজন ট্যাক্সিচালকের সাথে কথা হচ্ছিল, রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যাম দেখে তাঁর মন্তব্য– হবেই তো, জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে! জিজ্ঞাসা করলাম, জনসংখ্যাই যে সমস্যা, কী দেখে বুঝলেন? উত্তরটা যা এল, তাকে বলা যেতে পারে হামেশাই ট্রামে বাসে, বাজার-হাটে শোনা দেশের সমস্যা নিয়ে গড়পড়তা আলোচনার নির্যাস। মনে পড়ল, ২০ জানুয়ারির খবরের কাগজেই দেখেছি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতজি উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে বলে এসেছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হবে তাঁদের পরবর্তী কর্মসূচি!
ড্রাইভার সাহেবের উত্তরটা ছিল– রাস্তায় এত মানুষের মানুষের ভিড়, যেদিকে যান গাড়ির লাইন লেগেই আছে। ছেলেমেয়েগুলো বেকার, কাজ পাচ্ছে না, সেখানেও লাইন। হাসপাতালগুলোতে কীরকম ভিড় দেখেছেন? আরও কী প্রমাণ দরকার!
গাড়ি তখন শিয়ালদহ ব্রিজের জ্যামে পুরোপুরি নিথর। সেই সুযোগে আবার জানতে চাইলাম, কিন্তু আপনার গ্রামে? সেখানেও কি একই অবস্থা? সারাদিন রাস্তাঘাটে ভিড়, মানুষ গিজগিজ করছে? স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কি রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে?
এবার তাঁর উত্তরটা অন্যরকম। গ্রামে আবার রোজ রোজ তেমন ভিড় কোথায়? বেশিরভাগ লোক তো শহরমুখী। কাজের আশায় ভোর না হতেই দৌড়চ্ছে শহরের ট্রেন ধরতে। স্টেশনের কাছে কিছুটা ভিড়ভাট্টা হয় বটে, তাও ভোরে আর সন্ধ্যায়। সারাদিনে গ্রামের অনেক বাড়িতে পড়ে থাকে শুধু বুড়োবুড়িরা আর কিছু কাচ্চা-বাচ্চা। স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো কিছু গ্রামে টিমটিম করে চলে, আর বাকিগুলো যেন ভূতের বাড়ি! লোকে ওখানে ঠিকমতো চিকিৎসা পেলে কি আর কলকাতায় এত কষ্ট করে ভিড় করতে আসত?
আবার জানতে চাইলাম, লোকসংখ্যা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সেটাই যদি প্রধান সমস্যা হয়, তাহলে দোকানে, বাজারে বিক্রি না হওয়া খাবার জিনিস থেকে শুরু করে জামাকাপড়, জুতো সব পড়ে থাকছে কেন? জনসংখ্যা বেশি হলে আরও জিনিসের জন্য হাহাকার পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তৈরি জিনিসই পড়ে থাকছে কেন? বেশি মানুষ মানে তো বেশি কাজের শক্তি। তারা তো শুধু খায় না, দু’হাতে কাজ করে। বেশি মানুষের চাহিদা মেটাতে বেশি উৎপাদন করতে হলে নতুন নতুন কারখানা খুলে আরও উৎপাদন করতে হয়। তাহলে আরও কাজ করার লোক লাগত। চাকরির জন্য লোকে হন্যে হয়ে ঘোরার বদলে চাকরি দিয়ে শেষ করা যেত না। তেমনটা কি হচ্ছে? নতুন নতুন কারখানা কি খুলছে, চাকরির বাজার কি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে? আপনার গাড়িতে চড়ার লোকও কি অনেক বেড়ে গেছে? তার মানে প্রচুর রোজগার হচ্ছে, আপনি কাজ করে সামাল দিতে পারছেন না? চাষি যা ফসল ফলাচ্ছে তা বাজারে নিয়ে গেলেই কি এত কাড়াকাড়ি পড়ছে যে, সব বিক্রি হয়ে তার ঘরে প্রচুর টাকা আসছে? দেখা গেল এই উত্তরেও তিনি দু’দিকে মাথা নাড়ছেন।
এবার বলতে শুরু করলেন, কোথায় বিক্রি, কোথায় রোজগার? আমি তো চাষ ছেড়ে এমনি এমনি ট্যাক্সি চালাতে আসিনি! ভাইটাকে গ্রামে দোকান করে দিয়েছিলাম তাও এখন বন্ধ, বাজার নেই? কত ছেলে যে কাজের জন্য রোজ শহরে ছোটে তার ঠিক আছে নাকি? কারখানা নতুন নতুন খুলছে কোথায়? এই কলকাতাতেই বড় বড় কতগুলো কারখানার জমিতে জঙ্গল গজিয়েছে, দেখেননি? আমিও তো বসেই থাকি বেশিরভাগ সময়। এত ট্যাক্সি রাস্তায় নেমেছে, অনেকেই কিছু উপায় না পেয়ে এই লাইনে চলে আসছে। এত গাড়ি, চড়ার লোক কোথায়?
তাহলে দেশের প্রধান সমস্যা কি জনসংখ্যা বৃদ্ধি? নাকি সমস্যার আসল কারণ কোটি কোটি মানুষের পরিশ্রমের ফসল মুষ্টিমেয় মালিকের পকেটে গিয়ে ঢোকা। তাতেই বাড়ছে সমস্ত ধরনের সমস্যা। কপালে ভাঁজ পড়ল ড্রাইভার ভদ্রলোকের। বলে গেলেন বিষয়টা তিনি ভেবে দেখবেন।
এই কথোপকথনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মিলিয়ে দেখা যাক আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের কথাকে। তাঁদের সংগঠনের কর্মকর্তারা আবার বলেছেন, লাতারে জনসংখ্যা কমানো নয়, তাঁদের নেতা বলে দিয়েছেন, ‘ভারতীয় বংশোদ্ভূত’ নয় এমন জনসংখ্যা বাড়ছে, ফলে তাদের সাথে হিন্দুদের সমতা আনতে হবে (আনন্দবাজার, ২০.০১.২০২০)। মনে পড়ে যায়, ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও দেশের প্রধান সমস্যা হিসাবে জনসংখ্যাকেই তুলে ধরেছিলেন। তাঁর কথার মধ্যেও ইঙ্গিত ছিল বিশেষ জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যাই যেন বাড়ছে!
কারা ‘ভারতীয় বংশোদ্ভূত’ নয়? আরএসএসের দর্শন বলে, মুসলিম আর ক্রিশ্চানরা। যদিও যাঁর ঘরে বসে নরেন্দ্র মোদি সাহেব ধ্যান করে গেলেন সম্প্রতি, সেই স্বামী বিবেকানন্দ সারা জীবন এর ঠিক বিপরীত কথাই বলে গেছেন। কিন্তু সে প্রসঙ্গ ছেড়ে নরেন্দ্র মোদির পুরনো একটি কথা এই প্রসঙ্গে বরং স্মরণ করা যাক, গুজরাট গণহত্যার সময় সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি মুসলমান শরণার্থী শিবিরকে‘সন্তান উৎপাদনের কারখানা’ বলে কদর্য ব্যঙ্গ করেছিলেন।
কংগ্রেসের নেতারাও দেশের মানুষ চাকরি চাইলে, খাদ্য চাইলেই একই ফাটা রেকর্ড বাজাতেন– জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলেই সব অভাব মিটে যাবে। বিজেপি তাতে মুসলিম জনসংখ্যার বিষয়টি যোগ করেছে মাত্র। সারা বিশ্বেই পুঁজিবাদী শাসকরা এমনকী যাঁকে দেখলেই মোদি সাহেব একেবারে আপ্লুত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন, সেই ট্রাম্প সাহেবও আমেরিকার মানুষকে বোঝান– অভিবাসীরা ঢুকে দেশের জনসংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে, সব চাকরি ওরাই নিয়ে নিল, ওদের আটকাও চাকরি পাবে, রোজগার পাবে। ভারতেও একই ধুয়ো তুলেছে বিজেপি।
জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেটাই কি একমাত্র সত্য? তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল দশ বছরে ২৩.৯ শতাংশ, ২০০১-এ তা কমে হয়েছে ২১.৫, ২০১১-র সেন্সাস দেখিয়েছে পরবর্তী দশ বছরে এই বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ১৭.৬। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টকে ভিত্তি করে একদল সমীক্ষক দেখাচ্ছেন, সারা পৃথিবীতেই এখন নতুন সমস্যা হচ্ছে কর্মক্ষম তরুণের সংখ্যা কমে আসা। ভারতও সে দিকেই যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাঁরা দেখাচ্ছেন ২০৬০-এর মধ্যে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে কমবে। ফলে কর্মক্ষম মানুষেরই অভাব দেখা দিতে পারে (হান্না রিচি, আওয়ার ওয়ালর্ড ইন ডাটা, ১৫.০১.২০১৯)। পিউ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান সহ সব ভারতবাসীর ক্ষেত্রেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পৌঁছে যাবে ‘রিপ্লেসমেন্ট রেট’-এ। অর্থাৎ নতুন জন্মহার এবং মৃত্যু প্রায় একই হারে দাঁড়াবে (আনন্দবাজার, আগস্ট ২০১৫)।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নানা দেশ, যারা এখন বৃদ্ধের সংখ্যার ভারে চিন্তিত, তাদের সন্তান উৎপাদনের গড় হার একজন মহিলা পিছু ১.৬। সেখানে ২০১৫-১৬-র ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি অ্যান্ড হেলথ সার্ভে’ (এনএফএইচএস) দেখিয়েছে ভারতে এই হার একজন মহিলা পিছু ২.৩। কিন্তু এই পরিসংখ্যানে পুরোটা বোঝা যাবে না, কারণ পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, জম্মু-কাশ্মী সহ বেশ কিছু বড় রাজ্যে শহরাঞ্চলে এই জন্মের হার মহিলা পিছু ১.৭ থেকে ১.৯-এর মধ্যে। একমাত্র উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটের মতো রাজ্যে তা বেশি (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২২ জুন ২০১৬)।
মুসলিম জনসংখ্যা কি অত্যধিক বাড়ছে? এনএফএইচএস সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যখন ০.৭ শতাংশ হারে কমেছে, মুসলমানদের মধ্যে কমেছে .০৮ শতাংশ হারে। এই সমীক্ষা দেখিয়েছে জন্মহার ধর্ম বা বর্ণ ভিত্তিতে নির্ভর করে না। এই হার নির্ভর করছে আর্থিক পরিস্থিতি, শিক্ষার হার, সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদির উপর। এই সার্ভে দেখিয়েছিল মেয়েদের শিক্ষা, কন্যা সন্তানের সঠিক যত্ন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ে উন্নতি ঘটানোর সাথে জন্মহার কমার সরাসরি সম্পর্ক আছে। আর কী দেখা যাচ্ছে? আরএসএস প্রচারকরা সেন্সাস রিপোর্ট তুলে বলেন, দেখো হিন্দুদের জন্মহারের তুলনায় এখনও মুসলমানদের জন্মহার বেশি। হিন্দুদের মধ্যে বাৎসরিক জন্মহার ২.২ এবং মুসলমানদের ১.৫৬। এটুকু বললে পুরোটা বলা হল না। দেখা যাচ্ছে, গরিব এবং তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে মুসলমানদের গরিব অংশর জন্মহার হুবহু এক (আনন্দবাজার, আগস্ট ২০১৫) তাই তো মোহন ভাগবতজি ‘সমতা বিধানের’ দাওয়াই দিয়েছেন। তিনি তো সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা কমানোর কথা বলেননি!
মোহন ভাগবতজিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, ২০১১-র সেন্সাস এবং তাঁর সমর্থিত সরকারের আমলেরই এনএফএইচএস সমীক্ষা– সেখানে দেখানো হয়েছে, পুরুষ-নারী অনুপাতে প্রতি হাজার পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যায় মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে অনেক ভাল জায়গায় আছেন। মোহন ভাগতজিকে আরও স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে– ‘বেটি বাঁচাও’ নিয়ে বাকসর্বস্ব প্রচারে মোদি সরকার যত উদ্যোগী, কন্যা-ভ্রুণ হত্যা রুখতে তত নয় কেন? গুজরাট, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই তা বেশি, সরকারের রিপোর্টই তা বলছে। পরিসংখ্যান বলছে শুধু কন্যাভ্রুণ হত্যা নয়, অযত্ন, অবহেলায় পাঁচ বছরের নিচে কন্যা সন্তানের মৃত্যুও কমেনি। বছরে দু’লক্ষ কন্যা সন্তান এভাবেই শেষ হয়ে যায় (ইন্ডিয়া টুডে, ১৫ মে ২০১৮ এবং ডিডব্লু ডটকম, ১ আগস্ট ২০১৯)।
কোটি কোটি মানুষ চায় কাজ, দেশের মানুষের প্রয়োজনেরও শেষ নেই। বর্ধিত জনসংখ্যা মানে এই প্রয়োজন আরও বাড়া। জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু উৎপাদন জমে থাকছে। এই সমস্যার দায় ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধি’র ঘাড়ে চাপিয়ে রেহাই মিলবে না।