ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে শাসকদের ব্যর্থতার প্রতিবাদে ১৬ সেপ্টেম্বর দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখাল পাকিস্তানের ১০টি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের জোট ‘লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (এলডিএফ)। লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি সহ বড় শহরগুলিতে লাল পতাকা হাতে এদিন মিছিল করেন পাকিস্তানের খেটে-খাওয়া মানুষ। স্লোগান ওঠে, বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে, দেশের সমস্ত মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তা সহ শিক্ষা-স্বাস্থে্যর মতো বুনিয়াদী পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ ধসের মুখে দাঁড়িয়ে। মূল্যবৃদ্ধির বোঝায় জেরবার মানুষ। গত মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম মারাত্মক। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম আকাশছোঁয়া। পাকিস্তানে বিদ্যুৎ মাসুল সম্প্রতি ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যার বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে দেশ জুড়ে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন মানুষ। এই ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির জন্য আন্দোলনকারীরা পুঁজিপতি শ্রেণির অবাধ শোষণ ছাড়াও গত জুলাইতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) থেকে পাকিস্তান সরকারের নেওয়া ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণকে অনেকাংশে দায়ী করেছেন। কারণ ঋণ দেওয়ার বিনিময়ে এই সাম্রাজ্যবাদী অর্থসংস্থা পাকিস্তানের উপর বেশ কিছু কঠিন শর্ত চাপিয়েছে। সেসব মেনে পাকিস্তান সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার উপর থেকে সমস্ত ভর্তুকি তুলে নিয়েছে। পরিণামে খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলির ব্যাপক দাম বৃদ্ধি ঘটেছে। বাস্তবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের উপর এই বিপুল ঋণের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে এর যাবতীয় সুবিধা লুটে নিচ্ছে পাকিস্তানের শাসক ধনিক শ্রেণি। বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মাশুল বৃদ্ধির জন্যেও আন্দোলনকারীরা দায়ী করেছেন বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির সঙ্গে সরকারের অন্যায্য নানা চুক্তিকে। দেশের মানুষের এই দুঃসহ পরিস্থিতির জন্য আন্দোলনকারীরা সামরিক খাতে সরকারের বিপুল ব্যয়কেও দায়ী করেছেন।
মোট বাজেটের ১৭ শতাংশেরও বেশি সামরিক খাতে ব্যয় করে পাকিস্তানের পুঁজিবাদী শাসকরা। ভয়ঙ্কর আর্থিক সঙ্কটে জনগণের যখন নাভিশ্বাস উঠছে, সেই সময়েও সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে ছাড়েনি সেখানকার শাসকরা।
দেশের নাম জানা না থাকলে জনগণের এই দুর্ভোগের বিবরণ পড়ে মনে হয় না কি, যে ভারতের জনসাধারণের দুর্দশার কথাই বলা হচ্ছে? আসলে ভারত ও পাকিস্তান– এই দুই রাষ্টে্রর পরিচালকদের মধ্যে একটা আপাত-বিরোধ চোখে পড়লেও দুই দেশের সাধারণ মানুষই নিজের নিজের দেশের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনায় একই রকম ভাবে পিষ্ট হচ্ছে। শুধু এই দুটি দেশই নয়, বিশ্ব জুড়ে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই জনগণ একইভাবে পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের শিকার। তাই কমিউনিস্টরা ঘোষণা করে যে, বিশ্ব জুড়ে শোষিত মানুষের স্বার্থ একই। দেখায়, মুনাফার স্বার্থে পুঁজিপতিদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও জনগণের স্বার্থের কোনও বিরোধ নেই।
এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে দু’বেলার রুটি জোগাড় করা যখন জনগণের অসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখনও পাকিস্তানের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির যাবতীয় কর্মকাণ্ড নির্বাচনে ফয়দা তোলাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু ভোটে সরকার বদল নয়, জনগণের দাবি আদায়ে আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা– এ কথা জেনে জনগণের দাবি-দাওয়া শাসকদের মানতে বাধ্য করার লক্ষ্যে জোট বেঁধেছে পাকিস্তানের ১০টি বামপন্থী দল। এদের মধ্যে আছে মজদুর কিসান পার্টি, আওয়ামি ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ পাকিস্তান সহ বামপন্থী দলগুলি। দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে সরকারি পদক্ষেপ, সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো বুনিয়াদী ক্ষেত্রগুলিতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ সহ দেশে গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দাবিতে বামপন্থী জোটের নেতৃত্বে পাকিস্তানের মানুষ আন্দোলনে নেমেছেন।