কোনও ধর্মে বিশ্বাস মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। তাই নিয়ে উৎসব বা শোভাযাত্রাও চালু রীতি। কিন্তু সেই শোভাযাত্রা থেকে অন্য ধর্মের মানুষের উপর আক্রমণ কোনও যথার্থ ধর্মবিশ্বাসী মানুষই চান না। অথচ বিজেপি-সংঘ পরিবার রামনবমীর শোভাযাত্রার নামে ঠিক তাই ঘটাল।
রামনবমীকে কেন্দ্র করে বিজেপি-আরএসএস বাহিনী দেশের নানা জায়গায় ধারালো অস্ত্র, উত্তেজক স্লোগান সহ যে মিছিলগুলি করেছে, সেগুলির লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে নানা ভাবে প্ররোচনা তৈরি করে সংঘর্ষ বাধানো এবং তাকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের নিশানা করা, পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে ধরপাকড় চালানো, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, দরিদ্র মানুষের বসতি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া। আর এ সবই চলল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে। এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট– একদিকে সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করা, অন্য দিকে হিন্দুত্বের জিগির তুলে সংখ্যাগুরুর ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা। গুজরাট থেকে ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ থেকে পশ্চিমবাংলা সর্বত্রই এই বাহিনী একই কাজ করেছে।
গুজরাটের আনন্দ জেলার খাম্বাট শহরে রামনবমী উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের উপর। মধ্যপ্রদেশের খরগোনেও একই ভাবে রামনবমীর মিছিলে সংঘর্ষের দায় সংখ্যালঘুদের উপর চাপানো হয়েছে। দুই জায়গাতেই প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের নিছক সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে নির্বিচারে বাড়ি-দোকানে ভাঙচুর করা হয়েছে।
দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী এলাকায় রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের পর এক বিজেপি নেতার অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তর দিল্লি পুরসভা বেআইনি নির্মাণ ও বসতি উচ্ছেদের নাম করে বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মূলত গরিব এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের, হকারদের দোকান, বসতি বুলডোজার এবং জেসিবি মেশিনের সাহায্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এর ফলে শয়ে শয়ে মানুষ তাদের সামান্য জীবিকা এবং ন্যূনতম বাসস্থানটুকুও হারিয়ে রাতারাতি অন্নহীন, আশ্রয়হীন পথের ভিখারিতে পরিণত হয়। একদিকে হুমকি, প্ররোচনা এবং ব্যাপক উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি করে তাদের সন্ত্রস্ত করে রাখা, অপরদিকে জীবিকা, বাসস্থান কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারি করে দেওয়া– এই দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে ফেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর এমন চাপ তৈরি করা হচ্ছে যাতে তারা দেশের মধ্যেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে বাস করতে বাধ্য হয়।
একের পর এক দাঙ্গায় মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার, প্রাণহানি, সম্পত্তিহানি, লুঠতরাজ, ধর্ষণ-খুন ভারতে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপি-আরএসএস নিয়ন্ত্রিত সরকার, পুলিশ-প্রশাসন সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আর সেই সুযোগে আক্রমণকারী উগ্র হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি নির্বিঘ্নে বাধাহীনভাবে নির্মম অত্যাচার চালায়। আগে যা ছিল দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, গত কয়েক মাস ধরে তা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আগে যা ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির কাজ, এখন তার সাথে রাষ্ট্রীয় সহায়তা যুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলায় ‘চ্যাম্পিয়ন’ রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে চলার নির্দেশ দেন প্রশাসনকে। তারপরই এপ্রিল থেকে দুষ্কৃতী দমনের নামে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর বুলডোজার চালানো শুরু হল রাজ্যে রাজ্যে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় বিষয়টি বিজেপির পূর্ব পরিকল্পনা প্রসূত।
এবারের ঘটনায় সব জায়গাতেই একটা নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ করা হয়েছে। বিজেপি পরিচালিত পৌরসভাগুলি বেআইনি নির্মাণ উচ্ছেদের আদেশ জারি করছে, সঙ্গে সঙ্গে বিশাল পুলিশবাহিনী সহ বুলডোজার এবং জেসিবি মেশিন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে এবং দোকান-পাট, ঘর-বাড়ি, সবকিছুকে নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অজুহাত দিতে এরা পিছিয়ে নেই। সংখ্যালঘু মানুষেরা নাকি ঝোপঝাড় এবং দোকানের আড়াল থেকে হিন্দুদের মিছিলে আক্রমণ করেছে তাই এই ব্যবস্থা!
গোটা উচ্ছেদের প্রক্রিয়াটাই অসাংবিধানিক এবং বেআইনি। উচ্ছেদের জন্য কোনও রকম নোটিস, দলিল-কাগজপত্র পরীক্ষা, এ-সবের কোনও তোয়াক্কাই করা হয়নি। দোকান, ঘর-বাড়ি, অধিবাসীদের প্রথমে উচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোই নিয়ম। তারপর নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসনিক দলিল এবং কাগজপত্র আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখার কথা। দখলদার প্রতিপন্ন হলে নির্দিষ্ট যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রশাসনিক কোনও নিয়মই মানা হয়নি। এমনকি দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর উচ্ছেদ অভিযানের উপর সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিলেও তা অমান্য করে নির্বিচারে বুলডোজার চালানো হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ধ্বংসলীলা চলার পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কপি নিয়ে বুলডোজারের গতিরোধ করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে শাসকদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রায় সমাপ্ত হয়ে গেছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, উচ্ছেদের খড়গ শুধু সংখ্যালঘুদের উপর কেন? যদি ধরেও নেওয়া হয়, নির্মাণগুলি বেআইনি, তবে প্রশ্ন ওঠে এ দেশে কি শুধু তাঁরাই এই রকম নির্মাণ করছেন? আসলে, গোটা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা আজ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। করোনা অতিমারী ও অপরিকল্পিত লকডাউনের সুযোগে সমস্ত দেশজুড়ে পুঁজিপতিরা ব্যাপক ছাঁটাই চালিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন এবং বিপর্যস্ত। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে আরও অসহায় অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপি নেতাদের প্রতিশ্রুতির ফানুস ফেটে গিয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের এই ক্ষোভ যাতে সংগঠিত রূপ নিয়ে শাসকের বিরুদ্ধে ফেটে পড়তে না পারে, তাই সংখ্যালঘু সমাজকে নকল শত্রু খাড়া করে তাদের বিপথে পরিচালিত করতে চাইছে। সেজন্য সাধারণ মানুষকে ধর্মের আফিঙে আচ্ছন্ন করে দাঙ্গার আগুনের উত্তেজনার মধ্যে ঠেলে দেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প রাস্তা শাসকের হাতে নেই। এমনকী শুধু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোকে দিয়ে ষড়যন্ত্র পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। তাই সরাসরি প্রশাসনকে দিয়ে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মর্যাদাকে দিনের আলোয় পদদলিত করে চলছে আক্রমণ।
প্রশাসন এবং সংখ্যাগুরুর মৌলবাদকে এক করে ফেলা বাস্তবে ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপেরই নামান্তর। এই বিভেদের রাজনীতি কোনও অংশের শ্রমজীবী মানুষেরই কল্যাণ করবে না, সে তাঁরা যে ধর্মেরই উপাসক হোন না কেন। এর লক্ষ্য দেশের সঙ্কট থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে মানুষকে বিপথগামী করা। এ দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সব মানুষকেই ঐক্যবদ্ধভাবে এই ঘৃণ্য আক্রমণের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।