পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল বলে পরিচিত পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় হাতির আক্রমণ এখন একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ এবং গবাদি পশুর জীবনহানি কিংবা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা ঘটে চলেছে। এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, মাঠে চাষ করা এমনকি রাস্তাঘাটে বেরোতে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে এক দিনে তিনজনের মৃত্যু, পশ্চিম মেদিনীপুরের সদর ব্লক এবং খড়গপুর গ্রামীণ ব্লকে একই দিনে দুই মহিলার মৃত্যু, শালবনি ব্লকের ভাদুতলাতে একই দিনে গুরুতর আহত হয়ে দুজনের মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে চলেছে। এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঝাড়গ্রাম জেলায় ৮ জন মারা গেছে, আহত হয়েছে এক শিশুসহ ৪ জন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় জীবনহানি হয়েছে ৩ জনের, আহত ৮ জন। পুরুলিয়াতে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের। বাঁকুড়াতে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। ঘরবাড়ি ও কৃষি ফসল নষ্টের পরিমাপ করা দুঃসাধ্য।
একই দিনে পরপর মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনায় গ্রামে গ্রামে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, একই সাথে সরকারি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পক্ষ থেকে ২৮ মার্চ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দিয়ে অবিলম্বে নিহত ও আহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, নষ্ট ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণ এবং জরুরিকালীন পদক্ষেপে হাতির দলকে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি সমস্ত প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টিতে কিছুমাত্র গুরুত্ব দেওয়া দূরের কথা, উল্টে দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাই করা হয়েছে। ওই দিনই বিকেলে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের বক্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হাতির দলের সামনে থেকে জনসাধারণকেই দূরে থাকতে হবে।’ তা হলে ঘরবাড়ি চাষবাস নিয়ে মানুষ কোথায় যাবে? বাজারহাটে মানুষ যাবে না? জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল কর্মহীন মানুষের বাঁচার অবলম্বন কেন্দুপাতা, শুকনো ডাল সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়ে তারা বাঁচবে কী ভাবে? এ প্রশ্ন জেলাশাসকের কাছে বোধহয় গুরুত্বহীন। কেউ যাতে না বেরোয় সেজন্য কোথাও কোথাও মাইকে ঘোষণা করে দেওয়াতেই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ?
স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের এই ভূমিকায় প্রবল ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। আর এটা লক্ষ করেই সম্প্রতি বেলপাহাড়িতে একই দিনে তিনজনের মৃত্যুর পর বনদপ্তরকে নিয়ে ঝাড়গ্রাম প্রশাসন বৈঠক করেন এবং বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও রাজ্যগত ভাবে প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কিন্তু ফল কী হতে পারে, তা তাঁর বক্তব্যই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, দক্ষিণবঙ্গের ১৬টি জায়গায় ঘেরাটোপ করে হাতির খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ঝাড়খণ্ড থেকে এমনকি নেপাল, ভুটান থেকে হাতি পাচার করে ‘বিমাতৃসুলভ’ আচরণ করছে সেখানকার সরকারগুলো। যেন রাজ্যের তাই কোনও দায় নেই! তিনি আরও বলেছেন, ‘উত্তরবঙ্গে হাতি দলছুট হয় না, সারিবদ্ধ থাকে। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল কেটে দেওয়ায় হাতি দলছুট হয়ে পড়েছে’ (আনন্দবাজার, ২৬.৩.২৩)। সিপিএম সরকারের আমল থেকে এখনও পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় একদল জঙ্গল মাফিয়া জঙ্গল কেটে লুটে নিচ্ছে। থাকা এবং খাওয়ার ঘোর সংকটে পড়ে হাতির দল গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। পাকা ফসল খাচ্ছে এবং নষ্ট করছে। ঘরবাড়ি ভেঙে খিদের জ্বালা মেটানোর জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বা গবাদিপশু যা সামনে পড়ছে, নিহত বা আহত হচ্ছে। তা হলে এটা তো পরিষ্কার যে, এই পরিস্থিতির় জন্য দায়ী হাতি নয়, নিরীহ গ্রামবাসীরাও নন, দায়ী সরকারি মদতে জঙ্গল মাফিয়াচক্র। এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? এই চক্রের সঙ্গে নানা মহলের যোগসাজশের কথা এলাকার জনমানসে ওপেন সিক্রেট। কিন্তু প্রাণ যাচ্ছে এবং নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসী। অথচ সরকারি মন্ত্রী-আমলারা সবসময়ই দায়ী করেন সাধারণ মানুষকে! কেন তারা জঙ্গলে যাবে, কেন তারা হাতির সামনে ভিড় করবে, ইত্যাদি বলে তাঁরা মূল প্রশ্নটাকেই আড়াল করতে চান।
এলাকার মানুষ জঙ্গল থেকে পাতা তুলে, শুকনো কাঠ কুড়িয়ে বিক্রি করে, আর পিঁপড়ের ডিম, গাছের শেকড় বাকড় খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। শাসকরা এদের সংগ্রামের ফলটা নেয়, এদের ভোটটা নেয় কিন্তু মানুষ বলে মনে করে না। আধুনিক সভ্যতার অধিকার থেকে তারা চিরকাল বঞ্চিত করে রেখেছে বনবাসীদের। এখন হাতির কারণ দেখিয়ে জঙ্গলে ঢুকবার ও বেঁচে থাকবার অধিকারটাই কেড়ে নিতে চাইছে। বাস্তবে কর্পোরেটদের হাতে জঙ্গল, পাহাড় তুলে দেওয়ার যে নীতি সরকারগুলির, তারই পথ সুগম করে দিতে চায় এরা। সে জন্যই দেখা গেছে, হাতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রকল্প হিসেবে বামফ্রন্টের আমলে ২০০০ সালে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও অবিভক্ত মেদিনীপুরের ৪১৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় ‘ময়ূর ঝরনা এলিফ্যান্ট রিজার্ভ’ করার সিদ্ধান্ত হলেও বামফ্রন্টের ১১ বছর এবং বর্তমানে তৃণমূলের ১২ বছরে কিছুই হয়নি। আজ জরুরি প্রয়োজন, জঙ্গল মাফিয়ারাজ বন্ধ করা, চেকড্যাম তৈরি করা। বনাঞ্চলে উৎপাদিত স্বাভাবিক খাদ্য ও পানীয় হাতি সহ সকল বন্যপ্রাণীর জন্য সংস্থান করা। তবেই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে।