ভারতের মহাকাশযান ‘চন্দ্রযান-৩’ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেছে। এই সাফল্যকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে কৌতূহল ও উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। আবার একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির পক্ষ থেকে বিচিত্র এক উগ্র দেশাত্মবোধে সুড়সুড়ি দেওয়ার অপচেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নির্মোহ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করা দরকার মহাকাশ-গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির ক্ষেত্রে এই সাফল্য কেন গুরুত্বপূর্ণ, আর ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব ঠিক কতটা।
আমাদের চারপাশের প্রকৃতিজগৎ সম্পর্কে মানুষের জিজ্ঞাসা, কৌতূহল রয়েছে মানবসমাজের ঊষালগ্ন থেকেই। মানুষের যাবতীয় জ্ঞানের উৎস সেটাই। আর জানার মাধ্যম হল বিজ্ঞান। মানুষ তার চারপাশে যা দেখে তার সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন ওঠে তার মনে। সে তথ্য সংগ্রহ করে, তারপর তা বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করে এ সব বস্তুর চরিত্র কী, এগুলো সৃষ্টি হল কী ভাবে। এর মাধ্যমে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। যখন দেখা যায় একটি প্রশ্নের একাধিক উত্তর হতে পারে, তখন সে জানে এর মধ্যে সবকটি সত্য হতে পারে না। কারণ কোনও বিশেষ বিষয়ে সত্য একটাই। তখন প্রয়োজন হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বোঝার যে কোন উত্তরগুলি ভুল। এই পদ্ধতিতে ভুল চিন্তাগুলিকে অপসারণ করেই সে সত্যে পৌঁছয়। এ ভাবেই সৃষ্টি হয় মানুষের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডার।
বহুদিন থেকেই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সূর্য-গ্রহ-চাঁদ সংবলিত এই সৌরজগত। এ সব গ্রহ-উপগ্রহ কী দিয়ে গঠিত? তাদের সৃষ্টি হয়েছিল কী ভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে বিজ্ঞান কিছুটা অগ্রসর হলেও, যতক্ষণ না প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ হাতে আসছে, ততক্ষণ বহু প্রশ্নের উত্তরই অমীমাংসিত থেকে যায়। তাই প্রয়োজন চাঁদে, মঙ্গলে, শুক্রে অবতরণ করে এবং সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে এসব জ্যোতিষ্কের গঠন নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। বেশিরভাগ মহাকাশ অভিযানের উদ্দেশ্য সেটাই। চন্দ্রযানেরও।
কিন্তু কাজটা সহজ নয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে মহাশূন্যে অভিযানের প্রযুক্তি তৈরি হয়েছিল অনেক দিন আগেই। মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনও সফলভাবে করেছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। কিন্তু চাঁদের মাটিতে অবতরণ ব্যাপারটা একেবারেই অন্য রকম। পৃথিবী আর চাঁদের মাঝে একটি বিন্দু আছে যেখানে পৃথিবীর আকর্ষণ আর চাঁদের আকর্ষণ সমান হয়। অন্তত ততদূর পর্যন্ত পৌঁছনোর মতো জ্বালানি নিয়ে রকেটকে যেতে হয়। ওই বিন্দু পর্যন্ত সরলরেখায় সটান চলে যাওয়া যায় না। পৃথিবীর চারদিকে কয়েকবার পাক খেয়ে গতি সংগ্রহ করে তবে চাঁদের দিকে পাড়ি দেয় মহাকাশযান। এই পুরো পথটিই গণনা করে আগে থেকে স্থির করতে হয়, যাতে জ্বালানি সবচেয়ে কম লাগে।
এ ভাবে চাঁদের কাছাকাছি না হয় পৌঁছনো গেল, চাঁদের চারিদিকে পাক খাওয়া, ছবি তোলাও না হয় হল, কিন্তু চাঁদের মাটিতে অবতরণ করা হবে কী ভাবে? সজোরে আছড়ে পড়লে চলবে না, কারণ তাতে যন্ত্রপাতি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। যে উদ্দেশ্যে যাওয়া– সেই তথ্যসংগ্রহই করা হবে না। তাই অবতরণ করতে হবে ধীরে। এটাই সবচেয়ে কঠিন, কারণ চাঁদের কাছাকাছি চলে যাওয়া কোনও মহাকাশযানকে পৃথিবী থেকে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সে তখন চলছে বিপুল বেগে। ধরা যাক, চাঁদের দিকে মুখ করে গ্যাস বের করে দেওয়া হল। তাতে যানের গতি কিছুটা কমলো। কিন্তু কতটা? সেটা মেপে পরের পর্যায়ের রকেট চালু করা হবে। কিন্তু গতিবেগ মাপা হলেও রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে সে সংবাদ পৃথিবীতে পৌঁছোতে লাগবে ১.৩ সেকেন্ড। সেখানে কম্পিউটারে গণনা করে পরের নির্দেশ পাঠালে তা চাঁদে পৌঁছোবে আরও ১.৩ সেকেন্ড পর। ততক্ষণে মহাকাশযান চাঁদে আছড়ে পড়তে পারে। তাই পুরো নিয়ন্ত্রণই করতে হয় স্বয়ংক্রিয় ভাবে। কোথাও কোনও ভুল হলে পৃথিবী থেকে সংশোধনের কোনও সুযোগ নেই। তাই ধীরগতি অবতরণ প্রযুক্তির দিক থেকে এত কঠিন। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ এইটা করতে গিয়েই নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং চাঁদে আছড়ে পড়ে। গত ছয় মাসের মধ্যে আরও দুটি মহাকাশযান– একটি রাশিয়ার, আর একটি জাপানের– ধীরগতি অবতরণের চেষ্টা করেও পারেনি। ভেঙে পড়েছে। তাই চন্দ্রযান-৩-এর এই সাফল্যের জন্য ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের প্রশংসা প্রাপ্য।
এর আগে মাত্র তিনটি দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা চাঁদে ধীর-অবতরণ করতে পেরেছে– সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন। তবে এটা ঠিক, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা গত শতাব্দীর ষাটের দশকেই এ কাজে সফল হয়েছিলেন, যখন কম্পিউটার ছিল আজকের তুলনায় অনেক নিম্নমানের। তাদের মহাকাশযান লুনা-৯ ১৯৬৬ সালে এই কৃতিত্ব অর্জন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসাও মোটামুটি সেই সময়েই তা পেরেছিল। অর্থাৎ প্রযুক্তিটি কঠিন হলেও নতুন নয়। প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ্য যে, রাশিয়ায় পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে এ কাজে একবারও সাফল্যলাভ করেনি সে দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
যারা সেদিন টিভির পর্দায় চোখ রেখেছিলেন তাঁদের চোখে পড়েছে, যে সব বিজ্ঞানী এই অভিযানে ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের অনেকেই মহিলা। এটা একটা শুভ সংকেত। নারীরা যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে নেই– এই বিষয়টিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই ঘটনা।
চন্দ্রযান-৩-এর এই সাফল্য থেকে বিজ্ঞান কী পাবে? যে যানটি চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করতে পেরেছে, তার পেটের মধ্যে ছিল একটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি। তার মধ্যে ছিল বহুরকম যন্ত্রপাতি। সেই গাড়িটি চাঁদের মাটিতে নেমে আশেপাশের নানা জায়গায় যাবে, ছবি তুলবে, পাথর ও ধূলিকণা সংগ্রহ করবে, সেগুলি পরীক্ষা করে জানাবে তার উপাদান কী কী। যা জানা যাবে, তার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বিচার করবেন সৌরজগতের উদ্ভব ও চাঁদের সৃষ্টি নিয়ে যে তত্ত্বগুলি আছে তার মধ্যে কোনটি ঠিক কোনটি ভুল। জানার চেষ্টা করবেন চাঁদে জল আছে কি না। বাস্তবে এইজন্যই অবতরণ-স্থল হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি একটি অঞ্চলকে বাছা হয়েছিল, কারণ যদি জল থাকে তো এখানেই থাকার সম্ভাবনা সর্বাধিক। অন্য কোনও দেশ এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলে অনুসন্ধান চালায়নি। ভবিষ্যত মহাকাশ অভিযানে স্পেস স্টেশন হিসেবে চাঁদকে ব্যবহার করার সমস্যা ও সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের দিক থেকেও ধীর-অবতরণের সাফল্যের গুরুত্ব অনেক।
কিন্তু এই অভিযানকে যে ‘ভারতীয় বিজ্ঞানের’ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার যৌক্তিকতা কতখানি? বিজ্ঞান কোনও দেশের হয় না। বিজ্ঞান প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক, সমগ্র মানবজাতির প্রচেষ্টার ফসল। যে জ্ঞান ব্যবহার করে এই সাফল্য, তা সৃষ্টি করেছেন নানা দেশের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা আবার তা করেছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীর সৃষ্ট জ্ঞান ব্যবহার করে। যে নিউটনের তত্ত্ব ব্যবহার করে রকেটের গতিপথ গণনা করা হয়, তিনি ইংল্যান্ডের। যে লাপলাসের গণিত ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানানো হয়, তিনি ফ্রান্সের। রকেটে ব্যবহৃত তরল জ্বালানির রসায়ন যাঁরা উদ্ভাবন করেছেন, তাঁরাও ভারতের নন। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এইসব তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানের নাম করে জাতীয়তাবাদী লম্ফ-ঝম্প অবশ্যই নিন্দনীয়। তেমনই নিন্দনীয় অবতরণস্থলকে ‘শিব-শক্তি’ নামকরণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরো দপ্তরে গিয়ে স্বয়ং এই নামকরণের ঘোষণা করেছেন। যে কৃতিত্বে বিজ্ঞানের জয়, তাকে ধর্মভিত্তিক নামকরণের কোনও যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এটা ‘হিন্দু ভারতের জয়’ হিসেবে দেখানোর এবং তার মাধ্যমে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে সুড়সুড়ি দেওয়ার একটা ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।
মহাকাশে জ্যোতিষ্কদের এবং গ্রহ-উপগ্রহের পৃষ্ঠের নানা স্থানকে নামকরণ করার অধিকারী একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন। তাদের নামকরণের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলি আছে। তার ৯ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে– কোনও রাজনৈতিক, সামরিক বা ধর্মীয় নামকরণ করা হবে না (১৯ শতকের পূর্বেকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া)। বোঝাই যাচ্ছে এই নিয়মকানুন লঙ্ঘন করেই এই নামকরণ প্রস্তাব করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথের নানা ক্রিয়াকলাপ ও বক্তব্য মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করবে। চন্দ্রযান-৩-এর উৎক্ষেপণের আগে এই প্রকল্পের সাফল্য কামনা করে তিনি তিরুপতির মন্দিরে পুজো দেন। চন্দ্রযান-২-এর উৎক্ষেপণের আগে তৎকালীন চেয়ারম্যান শ্রী শিবনও অনুরূপ পুজো দিয়েছিলেন। সেবার বিফল হয়েছিল। এ বার তা সফল হবার পরে এস সোমনাথ বিবৃতি দিয়েছেন যে, আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুই নাকি বেদে ছিল।
মনে পড়ে যায়, বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহার জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমের অনিলবরণ রায়ের বিখ্যাত বিতর্কের কথা, যেখানে ডঃ সাহা বহু পরিশ্রম করে বেদ পড়ে উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্বই বেদে নেই। তা সত্ত্বেও আজ সরকার পক্ষের নেতারা এবং তাদের বশংবদ বিজ্ঞানীরা একই কথা বলে চলেছেন।
বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের প্রত্যাশা, এইসব অবিজ্ঞান-সুলভ মনোবৃত্তি কাটিয়ে উঠে ভারতের বিজ্ঞানজগত আরও অনেক কৃতিত্ব অর্জন করবে। কিন্তু তা করতে ভারতের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির বিজ্ঞানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। অন্যান্য উন্নতিশীল দেশে যখন মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ ব্যয় হয় বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে, সেখানে ভারত ব্যয় করে মাত্র ০.৮ শতাংশ। যতক্ষণ না ভারতের শাসকশ্রেণি অনুরূপ পরিমাণ অর্থ বিজ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যয় করতে সম্মত হচ্ছে, ততক্ষণ মহাকাশ গবেষণার মতো একটা-দুটো ক্ষেত্রে সাফল্য বিজ্ঞানচর্চায় ভারতের সার্বিক দৈন্যকে ঢাকতে পারবে না।